Tuesday 29 December 2009

পটচিত্র

পট্ট শব্দ হতে পট শব্দের উত্‍পত্তি৷ পট বা কাপড়ের উপর অঙ্কিত চিত্রের স্থলে কাগজ আবিষ্কারের পর তাতে ছবি অাঁকার প্রচলন হলেও পট শব্দ চিত্র অর্থে অভিধানে স্থান পেয়েছে৷ লোকশিল্পের একটা প্রাচীন মাধ্যম 'পট'৷ বৈদিক ও বৌদ্ধ গ্রন্থাবলীতে চিত্রাঙ্কনের উলেস্নখ দেখা যায়৷ ক্রীষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে পানিনির ভাষ্যকার পতঞ্জলী কর্তৃক উলেস্নখ এ চিত্রকর্মেও প্রাচীনত্বেও প্রমাণ৷ বুদ্ধদেবের জীবনী ও পূর্বজন্ম সংক্রানত্ম জাতকের গল্প সম্বলিত পট মস্করী ভিৰুরা প্রদর্শন করতেন৷ সপ্তম শতাব্দীর গোড়ার দিকে রচিত হর্যচরিত ও অষ্টম শতকের মুদ্রারাৰসে পটুয়াদেও উলেস্নখ আছে৷ দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতাব্দীতে পটুয়ারা সক্রিয় ছিলেন৷ পনেরো শতকের কবিরা সংস্কৃত সাহিত্য হতে রাধা-কৃষ্ণ, রাম-সীতা প্রমুখের কাহিনী বাংলা ভাষায় পরিবেশন করেন৷ এ সব কাহিনী অবলম্বনে এ সময় কৃষ্ণলীলা, রামলীলা পটের প্রচলন হয় বলে অনুমিত৷ ষোড়শ শতাব্দীতে চৈতন্যদেবের বাণী প্রচাওে পট অঙ্কিত হয়৷ ঐ শতকের কবি মুকুন্দরামের কাব্যে পটের উলেস্নখ আছে৷
গাজীর পটের প্রবর্তনের কাল পনেরো শতক বলে অনুমান করা হয়৷ এ সময় পীরবাদেও প্রভাব দেখা যায়৷ ইসমাইল গাজী সুলতান বরবক শাহের ( ১৪৫৯ - ৭৪ ) ধর্মপ্রাণ কর্মচারী ও বীর যোদ্ধা ছিলেন৷ তিনি সুলতানের নির্দেশে উড়িষ্যা ও কামরূপ জয় করেন৷ ষোড়শ শতাব্দির শেষভাগে শেখ ফয়জুলস্নাহ তাঁর বীরত্ব ও আধ্যাত্মিকতা উপজীব্য কওে গাজী বিজয় রচনা করেন৷ কিংবদনত্মীর এ গাজী কেলে শাহ একদিল গাজী নামেও পরিচিত৷ সুন্দরবনের বাঘের নিয়নত্মা হিসাবে বাওয়ালী বা কাঠুরিয়া এবং মাওয়ালী বা মধু সংগ্রহকারীদেও বাঘবন্দী মন্ত্রে তাঁর নাম উচ্চারিত হয়৷
এক হাজার বছর আগে হতে ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যনত্ম পটুয়ারা পট প্রদর্শন করতেন৷ বিগত শতাব্দী এমন কি বর্তমান শতকের গোড়ার দিকেও ঢাকা, নোয়াখালী, ময়মনসিংহ, রাজশাহী জবেং পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটি জেলাতে পটুয়া সঙ্গীতসহ পট চিত্র প্রদর্শণ করতেন বলে অমিয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় সূত্রে জানা যায়৷
পট অঙ্কিত হতো কাপড়ের উপর৷ এরপর কাপড়ের উপর কাগজ লাগিয়ে মানচিত্রের মতো তা অাঁকা হতো৷ কাপড়ের উপর কখনো কেবল কাদামাটি কখনো গোবর মিশ্রিত প্রলেপ দিয়ে, তার উপর তেঁতুল বিচির আঠা বুলিয়ে চিত্রের জন্য মসৃন ও দীর্ঘস্থায়ী জমিন তৈরি করা হতো৷ ইটের গুঁড়ার সঙ্গে তেঁতুল বিচির আঠা মিশিয়েও জমিন তৈরী করা হতো৷ পট অাঁকা হয়ে গেলে পট শিল্পী নিজে সঙ্গীত সঙ্গতে তা প্রদর্শন করেন৷ বিক্রমপুর অঞ্চলে পট প্রদর্শনকে 'পট নাচান' বলা হয়৷ পটুয়াদের বহুমুখী প্রতিভার জন্য বলা হয় _ 'একাধারে ইহারা ভক্ত সাধক কবি গায়ক ও চিত্রশিল্পী অর্থাত্‍ একদেশদর্শী শিল্পী নন'৷ অবশ্য পটশিল্প ও তার প্রদর্শক কোনো কোনো ৰেত্রে ভিন্নও হন৷
বিষয়বস্তু এবং আকৃতির উপর ভিত্তি করে পটের শ্রেণীবিন্যাস করা হয়৷ ছোট আকৃতির একক চিত্র বিশিষ্ট পটের নাম 'চৌকা পট' এবং বহু চিত্র সম্বলিত পট 'দীর্ঘ পট' বা জড়ানো পট (ংপত্‍ড়ষষ) নামে পরিচিত৷ চৌকা পটের আয়তন দৈর্ঘ্যে এক ফুট বা কিছু অধিক, প্রস্থ ৬"_৮"৷ অজিতকুমার মুখোপাধ্যায়ের মতে, জড়ানো পট ১৫ হতে ৩০ ফুট লম্বা, ২ হতে ৩ ফুট চওড়া৷ যাদু পটুয়াদেও জড়ানো পট অপেৰাকৃত ছোট এবং পশ্চিম বঙ্গের সাঁওতাল এবং পূর্ববঙ্গেও বেদেদের (ুইবফরুধং ড়ভ ঊধংঃবত্‍হ ইবহমধষরচ্) কাছে তা প্রদর্শিত হয়৷
চৌকা পটের আওতায় আসে দু'রকমের পট ঃ চৰুদান পট ও কালিঘাটের পট৷ মৃত ব্যক্তির কল্পিত ছবি এঁকে পটুয়া তাতে চোখের তারা অবশিষ্ট রেখে প্রয়াত ব্যক্তির আত্মীয়-স্বজনের কাছে এসে চিত্রকর বলে, চোখের মনির অভাবে মৃত ব্যক্তি স্বর্গে যাবার পথ খুঁজে পাচ্ছে না৷ উপযুক্ত দর্শনী নিয়ে পটুয়া তার স্বর্গের দ্বার উন্মোচন করে৷ গুরম্নসদয় সংগ্রহশালায় কিছু চৰুদান পট রৰিত আছে৷ স্টেলা ক্রামরিশ এই পটুয়াদের বলেন 'যাদু পটুয়া'৷
অষ্টাদশ শতাব্দী হতে বিংশ শতাব্দির প্রথম ভাগ পর্যনত্ম কলকাতার কালিঘাট মন্দিরের দূরের অবস্থিত পটুয়া পাড়ায় কালিঘাটের পট নামে খ্যাত কাগজের উপর তুলির টানে অঙ্কিত চৌকা পটের প্রসার ঘটে৷ এ পটুয়ারা প্রথমে সূত্রধর পওে প্রতিমা শিল্পী এবং তার পওে পটশিল্পীতে রূপানত্মরিত হন৷ এসব ছবি সসত্মায় বিক্রয় হতো৷ দীনেশচন্দ্র সেন একখানা পটের দাম দু'পয়সা বলে উলেস্নখ করেন৷ এজন্য এগুলিকে "নধুধত্‍ ঢ়ধরহঃরহমং" বলা হতো৷ ুঞযব ঢ়ধরহঃরহমং ধহফ নত্‍ঁংয ফত্‍ধরিহমং ধত্‍ব সড়হঁসবহঃধষ রহ ঃযবরত্‍ ত্‍বঢ়ত্‍বংবহঃধঃরড়হ ড়হ ড়ঃযবত্‍রিংব সড়ংঃষু নষধহশ ঢ়ধমব.চ্ বলেন স্টেলা ক্রামরিশ৷
কালিঘাটের পট আজ বিলুপ্ত৷ পটুয়ারা আবার মূর্তি পুতুল গড়ার পেশা গ্রহণ করেছেন৷ আনুমানিক ষাট বছর বয়স্ক শীশচন্দ চিত্রকর (পাল) একমাত্র ব্যতিক্রম৷ এ লেখকের সঙ্গে ১৯৮৭ সালের ২৭শে জুন এক সাৰাত্‍কারে তিনি বলেন, সরকারের ইচ্ছা একটি প্রশিৰণ কেন্দ্র খুলে তিনি আবার পটুয়া গোষ্ঠী গড়ে তুলুন৷ কিন্তু তাতে প্রশিৰণ প্রাপ্তদের পেটের ভাত জুটবে কিনা সে বিষয়ে তিনি সন্ধিহান৷
বিষয়ভিত্তিক শ্যেণীবিন্যাসে আছে চন্ডীপট, শক্তিপট, দশ অবতার পট, রামলীলা পট, কৃষ্ণলীলা পট, মনসাপট, যমপট ও গাজীর পট৷ চৰুদান পট আর যাদু পটও এ শ্যেণীর আওতাভুক্ত৷ নাম হতে পটগুলির বিষয়বস্তু অনুমান করা হয়৷ কাহিনী চিত্র সম্বলিত জড়ানো পটের শেষের দিকে কয়েকটি প্যানেলে পরকালে পাপাচারীদেও যমের দেয়া শাসত্মির কিছু চিত্র তুলে ধরা হয়৷ তাই এর নামকরণ যমপট৷ তাতে নৈতিক অধঃপতন রোধের চেষ্টা দেখা যায়৷ পঞ্চকল্যাণী পট নামক এক পটের উলেস্নখ করেন আশুতোষ ভট্টাচার্য৷ তাতে একক কোনো দেবদেবীর লীলা অঙ্কিত না হয়ে বিভিন্ন দেবদেবীর এক একটি লীলা অঙ্কিত৷ এ পটের জমিন অবশ্য মৃত্‍পাত্র এবং তার শিল্পী কুম্ভকার৷ উলেস্নখ্য যে; পট অনেক সময় বিগ্রহের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হয়৷ ব্যবসায়ীরা এককালে তাঁদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পট ঝুলাতো বলে জানা যায়৷
"জড়ানো পটের উত্‍স নিশ্চিতভাবেই অজানত্মার দেয়ালচিত্র৷ ঐ চিত্রের নিকটতম প্রতিবেশী অন্ধ্র স্কুল"৷ বলেছেন বোরহানউদ্দিন খান ঝাহাঙ্গীর৷ কল্যাণকুমার গঙ্গোপাধ্যায়ের মতে, অষ্টাদশ শতাব্দীর রাজধানী বিশেষ করে জয়পুর ধারা এবং ঐ সময়কার মোগল চিত্রকলার কিছু প্রভাব এই শিল্পে দেখা যায়৷ বিনয় ঘোষ পটের বলিষ্ঠ রেখায় মুসলিম ক্যালিগ্রাফী বা হসত্মলিপির প্রভাবের কথা উলেস্নখ করেন৷ অমিয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, "উলেস্নখিত শিল্পধারার অনুরূপ কোনো দরবারী অঙ্কন রীতি বঙ্গদেশে বিকশিত না হলেও রঙ্গিন পট, পুঁথি ও পুঁথির পটচিত্রে অনত্মত পাল রাজাদেও কাল হতে এখানে একটা নিজস্ব শিল্পরীতে গড়ে ওঠে৷ উভয়েই বাঙালি মনীষার নিজস্ব সৃষ্টি, নিকট বা দূরের রীতি দ্বারা প্রভাবিত নয়"৷ এ পদ্ধতিটিট দীর্ঘস্থায়ী হতে পারেনি৷
চিত্রশৈলী সম্পর্কে ওয়াকিল আহমদের ধারণা বিরূপ৷ "পটচিত্রের সূ্থল রেখার কায়া আছে সূৰ রঙ্গেও মায়া নেই"৷ এ মতের বৈপরীত্ব দেখা যায় কল্যাণকুমার গঙ্গোপাধ্যায়ের উক্তিতে _ ুঞযব ঢ়ধঃধং ধত্‍ব ভষধঃ রহ ঃত্‍বধঃসবহঃ নঁঃ ঃযবরত্‍ ষধহমঁধমব রং নবংঃ ঁহফবত্‍ংঃড়ড়ফ রহ ঃযব ারমড়ত্‍ড়ঁং ধহফ ংবিবঢ়রহম ড়ঁঃষরহবং ধহফ রহঃবহংবষু ড়িত্‍স পড়ষড়ত্‍.চ্৷
বিশেষ কওে কালিঘাটের পট সম্পর্কে অজিত মুখোপাধ্যায়ের সাধুবাদেও ভাষা হলো ুঃযব ষরহবং ধত্‍ব ফরংঃরহপঃষু নড়ষফ ংরিভঃ ধহফ ধঃঃত্‍ধপঃরাবচ্. সংযোজিত কলিঘাটের পটটি তার প্রমাণ৷ গ্রামবাংলার সহজ সরল জীবনের সার্থক প্রতিফলন ঘটে এ লোকশিল্পীদের সাধারণ তুলির টানে৷ দ্বিমাত্রিক ও সমতলভিত্তিক পটচিত্রে গতি আনয়ন করে তার বলিষ্ঠ রেখা আর রঙের উষ্ণতা৷ স্বাভাবিক আলোকে প্রদর্শিত হয় বলে পটের রং সাধারণত উজ্জ্বল৷ নাটকীয়ভাবে সঙ্গীত সঙ্গতে তার প্রদর্শন গুটান চিত্রে যেটুকু অপূর্ণতা থাকে, তা মোচন করে৷ বিষয় নির্বাচন, দৃশ্য নির্মাণ ও উপস্থাপনার কোনো ধরা বাঁধা নিয়ম নেই৷ স্বাভাবিক দৰতায় তাঁরা চিত্রাঙ্কন করে থাকেন৷
ড.সুকুমার সেন তাঁর "ইসলামী বাংলা সাহিত্য" গ্রন্থে উলেস্নখ করেন যে, উভয় বঙ্গের মধ্যে কেবল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশুতোষ মিউজিয়ামে একটি মাত্র গাজীর পট আছে৷ সম্প্রতি অবশ্য সে সংগ্রহশালা এবং গুরম্নসদয় দত্ত মিউজিয়ামেও একাধিক গাজীর পট সংগৃহীত হয়েছে৷
ফোর্ড ফাউন্ডেশন ও কারিকার যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত লোক কারম্নশিল্প জরিপ প্রকল্পের আওতায় গ্রাম পরিক্রমায় মোহনগঞ্জ হতে নরসিংদীর গাজীর পট প্রদর্শণীতে কোনাই মিয়ার খবর পেয়ে তার কাছে সুধীর আচার্য়েও হাতে অাঁকা একটা গাজীর পটের সন্ধান পাওয়া যায়৷ কোনাই মিয়ার সহায়তায় আমরা শিল্পী সুধীরচন্দ্রের সাৰাত্‍ লাভ করি৷ এভাবে সারা জীবনের নীরব সাধক এ পটশিল্পী আবিষ্কৃত হন৷
মুন্সীগঞ্জ জেলায় কাঠপট্টির কালিন্দীপাড়ায় আশ্রমসম গৃহে সুধীর আচার্যের নিবাস৷ ১৩১৯ সালের ৯ই চৈত্র তাঁর জন্মতারিখ৷ তাঁর বিশ বত্‍সর বয়সে পিতা প্রাণকৃষ্ণ আচার্য পরলোক গমন করেন৷ পিতামহ রামসুন্দর আচার্য এবং প্রপিতামহ রামগোপাল আচার্য সবাই ছিলেন পটশিল্পী৷ তাঁর আটাশ বছর বয়স্ক পুত্র শম্ভূনাথ আচার্যও একজন চিত্রকর৷ তিনি নারায়নগঞ্জের একটি বিদ্যালয়ে কমার্মিয়াল আর্টে শিৰা লাভ করেন৷ তাঁর রীতি ঐতিহ্যাশ্রয়ী নয়৷ পরিবারের প্রাচীন ধারাটি অৰুন্ন রাখার জন্য তাঁকে অনুরোধ জানানো হয়েছে৷ তন্তুরায় অধু্যষিত নরসিংদীতে এ পরিবারটি আট পুরম্নষ হতে তাঁতের শাড়ির পাড়ের নকশা অাঁকেন৷ সুধীর আচার্য জ্যোতিষ শাস্ত্রেও পারদর্শী৷ সব সম্প্রদায়ের লোক তাঁর আসত্মানায় আসেন গণনা ও ঝাড়ফুঁকের জন্য৷
পট অঙ্কনে তাঁর রীতি হলো, প্রথমে ইটের গুঁড়া কাপড় দিয়ে চেলে নেয়া৷ পাতলা কাপড়ে তা ছেঁকে তেঁতুল বিচির কষ বা আঠা দিয়ে গুলে একখানা গামছার উপরে তিনবার ও নীচে দু'বার তা লাগাতে হয়৷ পাউডার রঙ দিয়ে সাধারণ তুলির সাহায্যে ক্যানভাসের উপর সুধীর আচার্য পট আাঁকেন৷ মাটির উপর গামছা বিছিয়ে পট অঙ্কন করা হয়৷
লেখকের ব্যক্তিগত সংগ্রহে তাঁর অঙ্কিত যে পটটি আছে তার পরিমাপ ৪'-১০'*২',কয়েকটি প্যানেলে ভাগ কওে তার উপর লাল, নীল, হলুদ, সবুজ, গোলাপী, বাদামী, সাদা ও কালো রঙ লাগিয়ে ছবি অাঁকা হয়েছে৷ মাঝখানে আছে ৪'-১০*১'-৪" মাপের একটি বড় ছবি৷ তার উপরে ও নিচে তিন সারি ছবি৷ প্রতি সারিতে তিনটি কওে চিত্র অাঁকা৷ একেবারে নিচের সারিতে মাঝখানে দু'টি পিলার বা খামের ওপর তিনটি করে চিত্র অাঁকা আর্চ বা তোরণের নিচে তিনটি ছবি৷ এটিকে একটি ছবি ধরলে চিত্রের সংখ্যা দাঁড়ায় তেইশ, তিনটি ধরলে পঁচিশ৷ মাঝের বড় ছবিতে বাঘের পিঠে সওয়ার হয়ে আছেন গাজী পীর৷ তাঁর এক হাতে চামর, অপর হাতের মুষ্টি ঘিওে জ্যোতি৷
গাইন নামে পরিচিত গাজীর গানের গায়কদেও হাতে এ চামর ও আশা বা আশাদানা থাকে৷ তিনি আসা বা লাঠি মাটিতে পুঁতে তাঁরা হিন্দু মুসলমানদেও বাড়ি বা সমাবেশে মন্ত্রবত্‍ গাজীর গান পাঁচালি উচ্চারণ করেন৷ মানুষের মাথার উপর আসা বুলিয়ে তাদেও মঙ্গল কামনা করেন৷
বড়চিত্রের বাঘের সামনে ও পিছনে দ'জন লোক, একজনের হাতে কালো রঙের ত্রিকোণাকার পতাকা, একজন ধরেছে গাজীর মাথায় ছাতা৷
সুধীর আচার্য ছবিগুলির পরিচয় দিয়েছেন এভাবে উপরের বাম কোণ হতে (১) মকরবাহী গঙ্গা (২) ঘোড়া ও সহিস (৩) পুইস্কার বাবা মা (মাঝে হুক্কা) (৪) হরিণ জবাই, (৫) নাকাড়ায় বাড়ি ও (৬) গাজীর আসা (৭) চৈতার মা চিড়া কুটে, (৮) শিমূল গাছ, (৯) সওদাগরের বাণিজ্য যাত্রা, (১০) আন্দুরা বাঘ, (১১) গাজীর ছাতার দু'পাশে দু'টি টিয়া পাখি, (১২) খান্দুরা বাঘ, (১৩) উপরে উলিস্নখিত মাঝখানের বড় প্যানেল, (১৪) কুমিরের সওয়ার (১৫) লৰীদেবীর সিঁদুরের কৌটা, (১৬) স্বামী চুল ধরে মারে, (১৭) গোয়ালার গাভী নিলো বাঘে, (১৮) খোঁপা মাথায় নারী, (১৯) স্ত্রীলোককে বাঘে আক্রমণ, (২০) বৰিলা উল্টা করে বাঁধা, (২১) চরখায় সূতা কাটা, (২২) দধির ভারসহ গোয়ালা, (২৩) যমদূত, (২৪) যম রাজার মা, (২৫) কালদূত৷
নিচের তিনটি চিত্রের সংযোজন ইঙ্গিত করছে গাজীর পট হয়েও এটি একটি যমপট৷ কোনাই মিয়া অনুরূপ একটি পুরো পট প্রদর্শন করেন৷ প্রাসঙ্গিক পটুয়া সঙ্গীতে যম সম্পর্কিত তাঁর গানের পয়ার নিম্নরূপ _
যমদূত কালদূত ডাইনে আরো বায়৷
মধ্যখানে বইসা আছে যমরাজের মায়৷
যমদূত কালদূত দেইখ্যা লইবেন তারে
দুই হাতে দুই লোহার গদা যমের মতো ফিরে৷
যমরাজের মায় বইছে তামার ডেকচি লইয়া
অতি পাপী মানুষের কলস্না দিছে সে ডেগে ফালাইয়া৷
এই ছিলো কোনাই মিয়ার গানের সমাপ্তি৷ এর শুরম্ন গাজীকে নিয়ে৷
ধুয়া :
গাজীর নাম কেন লইলা নারে দেহের গুমান করে৷
দম দম বলিয়া মন দমে করি হিতি
এই দম ফুরাইয়া গেলে কি লইয়া বসতি৷
গাজীর বাপের নাম শাহ সেকান্দর৷
রওনক শহরে বানছে মদিনা বাড়ীঘর৷
পাতাল জিন্দা করে বিয়া বলিরাজের বেটা৷
সে ঘরেতে জন্ম নিল পীর জিন্দা গাজী৷
এ হলো কিংবদনত্মীর গাজীর বংশ পরিচয়৷ মাঝখানের বড় চিত্রের দু'টি লোকের পরিচয় মিলে কোনাই ব্যাপরীর পয়ারে৷
লোকঐতিহ্যের দশ দিগনত্ম
গাজীর ভাই কালু ছাতা ধরিলো
গামনেতে মানিকপীর নিসান ধরিলো৷
কালু গাজীকে তাঁর অলৌকিক ক্রিয়া প্রদর্শনের জন্য অনুরোধ জানান _
একযুগ বারো বছর রইলাম বনে বনে
কি ফকিরী পাইলা ভাই দেখাও আমারে৷
বারো বছর ধওে একটি শিমুল গাছ মওে আছে৷ সে গাছকে পুনর্জীবিত না করতে পারলে কালু তার সঙ্গ ছাড়বে৷
বিছমিলস্নাহ বলিয়া গাজী গাছে রাখে হাত৷
গাজীর দোয়ায় বাইচ্চা উঠে মরা শিমুল গাছ৷
ডশমুল গাছের অঙ্কন সরল৷ মাঝে কা-, দু'পাশে তিনটি কওে ছয়টি প্রশাখাহীন শাখা, তাদেও মাথায় এক একটি অনত্মর ফুল ও পাতা৷
পটুয়া সঙ্গীতটি চারটি অংশে বিভক্ত _ গাজীর অলৌকিক শক্তি, কিছু হিতোপদেশ, কিছু 'রঙের কথা', পরিশেষে যম৷
হিতোদেশের নমুনা :
রান্ধিয়া বান্ধিয়া অন্ন পুরম্নষের আগে খায়
ভরানা কলসের পানি তিরাসে ফুরায়৷
* * *
দুব দুবাইয়া হাটে নারী চোখ গোরাইয়া চায়৷
অলৰীওে দিয়া ঘরে লৰী লইয়া যায়৷
কিছু রঙ্গরস :
চুলনা বুড়ি চুলের লাগি কান্দে
কচুর পাতা দিয়া তার খোপা বড় করে৷
* * *
আটতে জানে না বুড়ি চিবি গুয়া খায়
ডবয়া সাদীর কথা শুনলে তুর তুরাইয়া যায়৷
পটুয়ারা পট দিয়ে বাড়িতে বাড়িতে পট দেখিয়ে পারিশ্রমিক হিসেবে ধান পায়৷ পটের মালিক একজন মহাজন বেদে৷ গায়ক গরীব বেদে৷ পটের জন্য তিন ভাগের এক ভাগ পায় মহাজন বেদে, গানের জন্য পায় দু'ভাগ৷ দুই যুগ আগে এ ছিলো ব্যবস্থা৷ এ তথ্য পাওয়া যায় সুধীর আচার্যের কাছে৷ এখন ধরতে গেলে পট তৈরী হয়ই না৷ বছরে চার পাঁচটা এখন বিক্রি হয়৷
ধর্ম ও নীতিজ্ঞানভিত্তিক সমাজের অবৰয় পটের বিলুপ্তির অন্যতম কারণ৷ পাশ্চাত্য শিল্পরীতিতে অঙ্কিত চিত্রের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পট টিকে থাকতে পারেনি৷ পট এককালে বিনোদনের মাধ্যমও ছিলো৷ এ ৰেত্রে এসেছে বৈপস্নবিক পরিবর্তন৷ ম্যাজিক ল্যানটার্ন এলো, নির্বাক সবাক চলচ্চিত্র এলো, এলো টেলিভিশন, ভিসিআর, ভি,সি,পি, ভিডিও ক্যামেরা৷ গুঁড়িয়ে দিলো লোকচিত্রের ঐতিহ্যকে৷ সুধীর আচার্য সে বিধ্বসত্ম অতীত এবং তার এক ৰীণ রেশের মধ্যে বন্দী৷ কালিঘাটের পটুয়া শ্রীশচন্দ্র চিত্রকর পেলেন সে দেশের রাষ্ট্রপতির পুরস্কার৷ সুধীরচন্দ্র আচার্যকে আমার জ্ঞাপন করছি আমাদেও প্রতিষ্ঠানের সামান্য স্বীকৃতি৷

Wednesday 2 December 2009

বাংলাদেশের চিত্রিত হাঁড়ি

লোক ও কারম্নশিল্প দৈনন্দিন প্রয়োজনের, উপযোগিতার, আমাদের যাপিত জীবনের-সংস্কৃতির অনুষঙ্গ, সাংস্কৃতিক উপাদান৷ আমাদের দেশের সংস্ক্রতির ক্রমবিকাশের প্রবহমান ধারা স্বনির্ভর গ্রামকেন্দ্রিক কৃষি-কারম্নশিল্প ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থায় লালিত৷ ফলে বাংলাদেশের গ্রামভিত্তিক লোকসমাজের সাধারণ মানুষের অনুভবে, চেতনায় জীবনের অঙ্গ হিসেবে লোক ও কারম্নশিল্প সংস্কৃতির ক্রমবিকাশের ধারায়, নিয়মে সৃষ্টি, বিকশিত, রূপানত্মরের ধারায় অব্যাহত, সক্রিয় রয়েছে৷ মানুষ জীবন যাপনের মতই লোক ও কারম্নশিল্পের ধারাকে সক্রিয় রাখতে সচেষ্ট এবং স্থানিক ও কালিক ব্যবধানে রূপানত্মর প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট ধারাকে অব্যাহত রাখার মাধ্যমে লোক ও কারম্নশিল্পকে প্রতিনিয়ত পুনরম্নজ্জীবনে আত্মনিয়োগ করে চলেছে৷
সাংস্কৃতিক ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ লোক ও কারম্নশিল্প প্রতিনিয়ত আমাদেও প্রতিদিনের জীবনে সহজাত, সক্রিয়৷ ফলে লোক ও কারম্নশিল্প সাধারণ জীবনের অভ্যাসের, রম্নচির, বৈশিষ্ট্যের এবং গোষ্ঠীর পরিচায়ক৷ জাতীয় জীবনে জাতিতাত্তি্বক মর্যাদার, গৌরবের বলে পরিগণিত হয়েছে৷ সংস্কৃতির পরিচয়ের বলে তা মানুষের জীবনাচারণের অনত্মর্ভূক্ত-জীবনঘনিষ্ঠ৷ জীবনের, সংস্কৃতির বহুমাত্রিকতার গুণে, বৈশিষ্ঠ্যে উজ্জ্বল লোক কারম্নশিল্প প্রতিনিয়ত মূল্যায়নের দাবি রাখে৷
মানুষ যেহেতু মনসত্মাত্তি্বক, সেহেতু অনুভব ও চেতনায় প্রয়োজন এবং উপযোগিতার নিরিখে লোক ও কারম্নশিল্পের চিত্রকল্প গড়ে৷ চিত্রকল্প রূপলাভ করে লোক ও কারম্নশিল্পের নানা সৃষ্টিতে৷ একদিকে লোক ও কারম্নশিল্প যেমন প্রত্যাহিক জীবনের প্রয়োজন মেটায় অপরদিকে অনুভব ও চেতনার জগতে সৌন্দর্যের আনন্দ বিকশিত হয়৷ সৌন্দর্যের পরিবেশ, সৌন্দর্য সৃষ্টি হয় লোক ও কারম্নশিল্পে৷ প্রয়োজন ও সৌন্দর্য যুগপত্‍ লোক ও কারম্নশিল্পে ক্রিয়াশীল৷ প্রয়োজনের জন্য লোক ও কারম্নশিল্পের উদ্ভাবন, গড়া হলেও এতে সৌন্দর্য ও সংস্কৃতির আলেখ্য সম্পৃক্ত৷
কারম্নশিল্প সৃষ্টিতে প্রয়োজনের নিরিখে এর গড়ন, আকার অবয়ব নির্দিষ্ট হয়৷ এতে সমন্বয়পূর্ণ, সদৃশরূপ বৈশিষ্ট্য যুক্ত হয়ে লোক ও কারম্নশিল্প ছন্দময়, রূপময়, বর্ণাঢ্য-সৌনন্দর্যগুণের হয়৷ অনুভব ও চেতনার মনোজগত কারম্নশিল্পীর মধ্যে কারম্নশিল্পের সৌন্দর্যের, গড়ণের নিখুত বৈশিষ্ট্যকে সনাক্ত করতে সহায়তা করে, অনুপ্রেরণা দেয়৷ পটভ্থমি, ভিত্তি, প্রেৰিত্‍ থাকে দেশ, প্রকৃতি, পরিবেশ, মানুষ, মানুষের যাপিত জীবনের প্রবহমান ধারা সংস্কৃতি৷ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রেৰিতে কারম্নশিল্পীর বংশ পরম্পরায়ের কৌশল ও দৰতায় সৃষ্টি হয় লোক ও কারম্নশিল্প৷ ফলে লোক ও কারম্নশিল্প নিছক আধুনিক ক্রাফট, হাতের কাজ, হসত্মশিল্প এই পদবাচ্য না হয়ে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বলে বিবেচিত হয়৷ কোন নির্দিষ্ট অঞ্চলের, জনপদেও, নৃগোষ্ঠীর, সম্প্রদায়ের, গোষ্ঠীর, উপজাতির, জাতির সংস্কৃতির পরিচয়বাহী হয়ে ওঠে লোক ও কারম্নশিল্প৷ অঞ্চল ভেদে, নানা অঞ্চলের মানুষের সাংস্কৃতিক, স্বাতন্ত্র্যেও বৈশিষ্ট্যও পরিচয়কে সনাক্ত করায়৷ লোক ও কারম্নশিল্প সাংস্কৃতিক, আঞ্চলিক স্বাতন্ত্র্যের ছাপ, বৈশিষ্ট্য ধারণ করে৷ বৈশিষ্ট্যেও নামে, রূপে ও গড়নে প্রতিষ্ঠা পায়৷
সাধারণ মানুষের জীবনাচারণ সংস্কৃতির অভ্যনত্মরস্থ বস্তু, আধেয়৷ সাধারণ মনুষের জীবনাচারণের ক্রমপুঞ্জিত ধারাবাহিক রূপের পরিচয়বাহী সাধারণ বৈশিষ্ট্য সংস্কৃতি ধারণ করে৷ এবং সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য উপাদান হিসেবে লোক ও কারম্নশিল্পে সাধারণ মানুষের জীবনাচারণের ক্রমপুঞ্জিত রূপকে, সংস্কৃতিকে পরিলৰিত করি৷ সংস্কৃতির ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা রৰিত, বজায় থাকে রম্নপানত্মরের মাধ্যমে পুনরম্নজ্জীবন প্রক্রিয়ায়৷ অনুরূপ প্রক্রিয়ায়, পদ্ধতিতে সাংস্কৃতিক উপাদান-লোক ও কারম্নশিল্প কালিক ব্যবধানে সাধারণ মানুষের রম্নচি, চাহিদার ভিত্তিতে ঐতিহ্যের, উত্তরাধিকারের নিরিখে প্রতিনিয়ত রূপানত্মরের মাধ্যমে পুনরম্নজ্জীবিত হয়ে চলেছে৷ লোক ও কারম্নশিল্পের রূপানত্মরের ধারায় পুনরুজ্জীবন প্রক্রিয়া সূচিত হয় বহুমাত্রিক লৰ্যে৷ লোক ও কারম্নশিল্প হতে সৌন্দর্যের, সুষম ও সুগঠিত, বর্ণাঢ্য, চিত্রগুণ সম্পন্ন লোক ও কারম্নশিল্পে পরিণত হওয়া রূপানত্মরের বহু ধারায় পথ পরিক্রমা মাত্র৷ বস্তুজাতসংস্কৃতি সংশিস্নষ্ট বস্তু, জিনিসের মৌলিক আকার, গড়ণ সময়ের ব্যবধানে সৌন্দর্যের, রূপের রঙের, নকশার, সুষমার লোক ও কারম্নশিল্পে পরিণত হয়ে থাকে৷ ক্রমশঃ লোকশিল্পীর কৌশল ও দৰতায় এতে পস্নাষ্টিক ও গ্রাফিকগুণের সমাহার, সমন্বয় ঘটেছে৷ চিত্র, খোদাই, প্রতিসমগুণসম্পন্ন হয়েছে৷ এভাবে নানা ধারায়, প্রক্রিয়ায় লোক ও কারম্নশিল্পের সৃষ্টির, কৌশলের ও দৰতার ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী কারম্নশিল্পী কালিক ও স্থানিক ব্যবধানে লোকসমাজের সাধারণ মানুষের রম্নচি, চাহিদার প্রেৰিতে রূপানত্মরের মাধ্যমে লোক ও কারম্নশিল্পকে চলমান রাখেন৷ ফলে লোক ও কারম্নশিল্প কখনো উপযোগিতার, কখনো সৌন্দর্যের, আচার-আচরণের৷ এবং প্রতিনিয়ত লোক ও কারম্নশিল্পের সৃষ্টির উদ্দেশ্যের, লৰ্যের বহুমাত্রিকতার গুণ, বৈশিষ্ট্য একে চলমান, অব্যাহত রেখেছে৷
বাংলাদেশের লোক ও কারম্নশিল্প এদেশের প্রকৃতি ও পরিবেশের আদি নৃগোষ্ঠির জীবনযাপনকেন্দ্রিক বস্তুজাত সংস্কৃতির উপর ভিত্তি কওে রূপলাভ করেছে৷ নব্যপ্রসত্মর যুগ থেকে এই অঞ্চলে বসবাসকারী অষ্ট্রিক ভাষাভাষী আদি নৃগোষ্ঠী ও পরবর্তীতে আগত অন্যান্য নৃগোষ্ঠীর মিলিত ও সমন্বিত জীবনযাপনকেন্দ্রিক বাংলাদেশের সংস্কৃতি-বস্তুজাতসংস্কৃতি রূপ পরিগ্রহ করে৷ বিকশিত হয়৷ একটি ভিত্তি তৈরী হয়৷
বস্তুজাত সংস্কৃতির পরিচায়ক এদেশের প্রকৃতি পরিবেশের কাঁচামাল উপকরণ মাটি, বাঁশ-বেত, কাঠ, তন্তুও তৈরি দৈনন্দিন ব্যবহার্য অতিপ্রয়োজনীয় জিনিস৷ যেমন (১) মাটি ঃ হাঁড়ি, পাতিল, কলসী, সানকী, বাটি, সরা, প্রদীপ (২) বাঁশ, বেত, শন, খড় ঃ শনের ঘর, বাঁশের ঘর, মাথাল, ঢুলা, কুলা, চালনি, খালই, ধামা, পলো, চাই (৩) কাঠ ঃ নৌকা, ঢেকী, বাক্স, দরজা, ঘরের খুটি, চৌকাঠ, লাঙ্গল (৪) তন্তু ঃ কাপড়৷ প্রাত্যহিক জীবনের জন্য দৈনন্দিন ব্যবহার্য এসব জিনিস বস্তুজাত, একানত্মই বাংলাদেশের সংস্কৃতির অনুষঙ্গ-বস্তুজাত সংস্কৃতির অনত্মর্ভূক্ত৷ এদেশের বৈশিষ্ট্যের গড়ণ এসব জিনিসে, বস্তুতে স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে৷ কালিক ব্যবধানে উলিস্নখিত বস্তুজাত সাস্কৃতিক উপাদান সমূহ ক্রমান্বয়ে আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় প্রেৰিতে রূপানত্মরের ধারায় সুষমার, সৌন্দর্যেও চিত্র, খোদাই এবং নকশাগুণের লোক ও কারম্নশিল্প পর্যায়ে উপনীত হওয়ার বৈশিষ্ট্য অর্জন করে থাকে৷ বস্তুজাতসংস্কৃতির জিনিস, পণ্য কালভেদে, স্থানভেদে আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে রূপানত্মরিত হয়ে সনাক্ত হয়েছে লোক সমাজের শিল্পকলা-লোক ও কারম্নশিল্প হিসেবে৷ বস্তুজাতসংস্কৃতির সকল আধেয়গুণ, বৈশিষ্ট্যে আরোপিত হয়েছে কারম্নশিল্পীর কৌশল, দৰতা ও সৌন্দর্যবোধ৷ ফলে লোক ও কারম্নশিল্প জাতিতাত্তি্বক-সাংস্কৃতিক৷ সবসবময় সকল কালে, স্থানে এই পরিচয় বহন করে চলেছে৷ লোক ও কারম্নশিল্প সকল সময়ে কোনো সঙস্কৃতির, জাতির, গোত্রের৷
মূলতঃ বাংলাদেশের বস্তুজাত সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য, মৌলিকত্ব, স্বাতন্ত্র্য এদেশের লোক ও কারম্নশিল্প ধারণ করে আছে৷ এদেশের মৃত্‍শিল্প বাংলাদেশের বস্তুজাত সংস্কৃতির নিরিখে, বৈশিষ্ট্যে রূপলাভ, বিকশিত হয়েছে৷ বস্তুজাতসংস্কৃতির অনত্মর্ভূক্ত মৃত্‍শিল্প দৈনন্দিন উপযোগিতা, প্রয়োজন মেটাতে উদ্ভব, সৃষ্টি হয়েছে৷ এদেশের আদি নৃগোষ্ঠীর জীবনধারার উত্তরাধিকারী আজকের বাংলাদেশের বৃহত্তম অংশ গ্রামের লোকজীবনের সাধারণ মানুষ মৃত্‍শিল্পকে চলমান, অব্যাহত রেখেছে৷ এবং আজকের মৃত্‍শিল্প-মৃত্‍পাত্রের ধারা প্রাচীন ধারাই অব্যাহতরূপ৷ এ প্রসঙ্গে ডঃ নীহারঞ্জন রায়ের মনত্মব্য "পোড়ামাটির নানা প্রকারের থালা বাটি, জলপাত্র, রন্ধনপাত্র, দোয়াত, প্রদীপ ইত্যাদি পাহাড়পুরের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে, বজ্রযোগিনীর সনি্নকটস্থ রামপালে, ত্রিপুরায় ময়নামতির ধ্বংসাবশেষের মধ্যে পাওয়া গিয়েছে৷ পাহাড়পুর, মহাস্থান, সাভার ইত্যাদি স্থানে প্রাপ্ত অসংখ্য পোড়ামাটির ফলক ও বিসত্মৃত মৃত্‍শিল্পের সাখ্য বহন করছে"৷ অর্থাত্‍ সাভার, ময়নামতি, বিক্রমপুর, পাহাড়পুর মহাস্থান বা পুন্ড্র অঞ্চলে প্রাপ্ত প্রাচীন লাল এবং ধুসর শ্রেণীর মৃত্‍পাত্রের অব্যাহত ধারা আজকের বাংলাদেশের মৃত্‍পাত্র৷
বস্তুজাত সংস্কৃতির জিনিস-মৃত্‍পাত্র প্রয়োজনের সেই সঙ্গে সৌন্দর্যের, বিশেষ আচার-অনুষ্ঠানের পরিণত হয়েছে৷ সনাক্ত হয়েছে লোক ও কারম্নশিল্পের বলে৷ স্থানিক ও কালিক ব্যবধানে আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রেৰিতে সাধারণ মৃত্‍পাত্র পরিণত হয় সৌন্দর্যেও, চিত্র ও নকশাগুণ সম্পন্ন বর্ণাঢ্য লোক ও কারম্নশিল্পে৷
বাংলাদেশেও মৃত্‍পাত্রের মধ্যে হাঁড়ি সাধারণ গৃহস্থালীর প্রয়োজন হতে সৌন্দর্য়ের, সুষমার, চিত্রগুণ সম্পন্ন চিত্রিত হাঁড়িতে পরিণত হয়েছে৷ অর্থাত্‍ সাধারণত দুই শ্যেণীর হাঁড়ি বাংলাদেশে পাওয়া যায়৷ (১) রান্না বান্নারকাজে, গৃহস্থালী প্রয়োজনে ব্যবহার্য নানা গড়ণ, মাপের, সাধারণ বড়, মাঝারি ও ছোট হাঁড়ি৷ (২) চিত্রিত হাঁড়ি৷ উত্‍সব, পাল-পার্বন-পূজা উপলৰে লোকমেলায় চিত্রিতহাঁড়ি গ্রামে আত্মীয়, কুটুম্বেও বাড়ীতে উপহার হিসেবে পাঠানো হয়৷ সাম্প্রতিককালে এই চিত্রিত হাঁড়ির ব্যবহারে আরো বৈচিত্র এসেছে যেমন এখন বিভিন্ন অনুষ্ঠানের তোরণ নির্মাণে ব্যবহার হয়৷ এবং শহওে নগওে বাড়ীঘরের বৈঠকখানায় চিত্রিত হাঁড়ি সংস্কৃতির পরিচায়ক, অহংকারের, গৌরবের বস্তু হিসেবে স্থান দখল কওে নিচ্ছে৷
অঞ্চলভেদে বাংলাদেশের চিত্রিত হাঁড়ির নাম, গড়ণ, নকশা, চিত্রগুণ এবং সৌন্দর্যে বিভিন্নতা, পার্থক্য লৰণীয়৷ এই চিত্রিত হাঁড়ির নাম কোথাও রঙ্গের হাঁড়ি, কোথাও শখের হাঁড়ি নামে পরিচিত৷ তবে বাংলাদেশে এই চিত্রিত হাঁড়ির অঞ্চলভেদে ভিন্ন ভিন্ন নাম থাকলেও রাজশাহী অঞ্চলের শখের হাঁড়ির নাম বিশেষ জনপ্রিয়৷ এখানে উলেস্নখ্য যে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও অনুুরূপ চিত্রিত হাঁড়ি তৈরী হয় এবং সেখানেও চিত্রিত হাঁড়ির নাম "শখের হাঁড়ি" বলে পরিচিত৷
বাংলাদেশের প্রায় অঞ্চলেই চিত্রিত হাঁড়ি পাওয়া যায়৷ এর মধ্যে উলেস্নখযোগ্য অঞ্চলগুলো হচ্ছে, রাজশাহীর সিন্দুরকুসুম্বী, বায়া, হরগ্রাম, বসনত্মপুর, চাপাই নবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ থানার বারোঘরিয়া গ্রাম, ঝিনাইগতি থানা, ঢাকার নয়ারহাট, কুমিলস্না, গোয়ালন্দ, রাজবাড়ী, ফরিদপুরের কোয়েলজুড়ি ও হাসরা, টাঙ্গাইলের কালিহাতি, জামালপুরের বজরাপুর, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডু থানার ইদিলপুর, ময়মনসিংহের বালাসুর বিশেষ উলেস্নখযোগ্য৷
অঞ্চলভেদে বাংলাদেশের চিত্রিত হাঁড়ির নাম, গড়ণ, নকশা, মোটিফ, চিত্রগুণ ও সৌন্দর্য সৃষ্টিতে বিভিন্নতা, পার্থক্য লৰণীয়৷ হাঁড়ির গড়নে অঞ্চলভেদে বৈচিত্র উলেস্নখ করার মতো, যেমন কোনো অঞ্চলে চিত্রিত হাঁড়িতে ঢাকনা আছে কোথাও ঢাকনা নেই, আবার কোনো অঞ্চলে চিত্রিত হাঁড়িতে হাতল রয়েছে৷ চিত্রে রং ও মোটিফের ব্যবহার রীতির আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য বিশেষ উলেস্নখযোগ্য৷
যেমন রাজশাহীর পবা থানার বসনত্মপুরের শখের হাঁড়িতে ব্যবহৃত মোটিফ, হাতী, ঘোড়া, পাখি, মাছ, রাজহাঁস, পাতিহাঁস, বিভিন্ন ধরনের ফুল, নকশী লতাপাতা, শাপলাফুল, পঁ্যাচা, কবুতর, চড়ুই পাখি ইত্যাদি৷ গোয়ালন্দেও শখের হাঁড়ির মোটিফ ইলিশ মাছ, শাপলা ফুল, পান লতা৷ রাজবাড়ীর শখের হাঁড়ির মোটিফ নকশী লতাপাতা ফুল৷
ঊাংলাদেশের লোক ও কারম্নশিল্পের এক অমূল্য সম্পদ চিত্রিত হাঁড়ি ধারণ করে আছে আবহমান বাংলার লোক সমাজের সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবন, ধর্ম-বিশ্বাস, লৌকিক আচার-আচরণ এবং উত্‍সব৷ আবহমান বাংলাদেশের সাধারণ গ্রামীণ মানুষ হলো এদেশের আদি নৃগোষ্ঠির সঙ্গে অন্যান্য অঞ্চল হতে পরবর্তীতে বিভিন্ন পর্যায়ে আগত নৃগোষ্ঠীসমূহের সম্মিলনে সমন্বিত জীবনযাপনের প্রবহমান এবং ক্রমপুঞ্জিত ধারায় কালিক ব্যবধানে সৃষ্ট রূপানত্মরিত রূপ৷ ফলে লোকজীবনের সৃষ্টি লোক ও কারম্নশিল্প জাতিতাত্তি্বক-সাংস্কৃতিক৷ এর বিশেস্নষণ ও মূল্যায়ন সংস্কৃতির বহুমাত্রিকতায়-জাতিতাত্তি্বক নিরিখে হওয়া বাঞ্চনীয়৷
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের লোক ও কারম্নশিল্পের অনত্মর্ভূক্ত চিত্রিত হাঁড়ির গবেষণা, বিশেস্নষণ, মূল্যায়ন জাতিতাত্তি্বক নিরিখে হওয়া অধিকতর যুক্তিযুক্ত৷ এ প্রসঙ্গে সাংস্কৃতিক ন্রতত্ত্ববিদ হ্যাজেল বার্জারের উক্তি বিশেষ প্রণিধানযোগ্য "ঙহব পধহ হবাবত্‍ সধশব ধ ফবঃধরষবফ ংঃঁফু ড়ভ ধ ড়িত্‍শ ড়ভ ধত্‍ঃ রিঃযড়ঁঃ ফবঃবত্‍সরহরহম রঃং ঢ়ষধপব রহ ঃযব ঃড়ঃধষ ংঃত্‍ঁপঃঁত্‍ব ড়ভ ঃযব পঁষঃঁত্‍ব ধং বিষষ ধং রহ যরংঃড়ত্‍রপধষ ংঃুষব ংবয়ঁবহপবচ্.
লোকশিল্পের জাতিতাত্তি্বক বিশেস্নষণ ও মূল্যায়নে হ্যাজেল বার্জারের গবেষণাধারা ও পদ্ধতি অনুসরণ কওে এর প্রয়োগের মাধ্যমে এ সম্পর্কিত বহুমাত্রিক ও সর্বাধিক তথ্য সংগ্রহ ও ব্যাপক, বিসত্মৃত অনুধাবন সম্ভব৷ হ্যাজেল বার্জারের গবেষণা ধারা, পদ্ধতি অনুসরণ কওে নিম্নলিখিত ধারায় লোক ও কারম্নশিল্পের গবেষণা, বিশেস্নষণ ও মূল্যায়ন করা যেতে পারে৷
(১) নির্দিষ্ট লোক ও কারম্নশিল্পের বিসত্মারিত ও বিজ্ঞানসম্মত বিশেস্নষণ ও মূল্যায়ন৷
(২) লোক ও কারম্নশিল্পের ব্যক্তি শিল্পী, কারিগরের জীবন বিশেস্নষণ ও মূল্যায়ন৷ বাংলাদেশের লোক ও কারম্নশিল্পের অনত্মর্ভূক্ত চিত্রিত হাঁড়ির গবেষণা, বিশেস্নষণ ও মূল্যায়নে উপরিউক্ত দুটি পদ্ধতি ও ধারায় সম্পন্ন করা যেতে পারে৷ এই গবেষণা পদ্ধতি ও ধারায় বাংলাদেশের লোকজীবনের মানুষের জীবনযাপনসম্বন্ধীয়-সংস্কৃতিবিষয়খ লোক ও কারম্নশিল্প চিত্রিত হাঁড়ির জাতিতাত্তি্বক নিরিখে বিশেস্নষণ ও মূল্যায়ন বিজ্ঞানসম্মত, সার্বিক ও বহুমাত্রিকগুণ সম্পন্ন হবে৷
ঊাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের চিত্রিত হাঁড়ির স্থানিক ও কালিক ব্যবধানে, এর পার্থক্য ও বৈশিষ্ট্যেও স্বরূপ উদঘাটনে এবং দেশের সংস্কৃতির রূপ অন্বেষণে লোকশিল্পের জাতিতাত্তি্বক বিশেস্নষণ ও মূল্যায়ন এক নতুন দিকনির্দেশনা প্রদানে সহায়ক ভ্থমিকা পালন করবে৷

লোকজউত্‍সব, মেলা

লোকজীবনধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত লোকসমাজের প্রথা, অভ্যাস রেওয়াজ, সামাজিক রীতিনীতি (পঁংঃড়স) মূলতঃ অতিপ্রাকৃত শক্তি, দৈববাণী, জাদুবিদ্যা প্রভৃতি অন্ধ বিশ্বাস ও সংস্কৃতিসংশিস্নষ্ট৷ লোকসমাজের প্রথায়, অভ্যাসে তার স্ফ্থরণ ঘটে৷ ফলে (পঁংঃড়স) সামাজিক প্রথা, অভ্যাস, রেওয়াজের সঙ্গে (ংঁঢ়বত্‍ংঃরঃরড়হং) অন্ধ বিশ্বাসের একটা ঘনিষ্ট সম্পর্ক রয়েছে৷ অন্ধ বিশ্বাসের মতো সামাজিক প্রথাতেও লোকসংস্কৃতির বাকজাতীয় (াবত্‍নধষ) ও বস্তুজাতীয় (হড়হ াবত্‍নধষ) উপাদান বর্তমান৷ লোকসাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সুনির্দিষ্ট অবস্থায় তা প্রয়োগযোগ্য৷
মূলতঃ লোকজীবনে (ভড়ষশ ষরভব) কোন লোকসমাজের মানুষের ঐতিহ্যিক দিক লোকসাহিত্য, লোক সঙ্গীত, আচার- আচরণ, অনুষ্ঠান, বিশ্বাস এবং বস্তুজাতসংস্কৃতি-লোক কারম্নশিল্প৷ এ কারণে লোকজীবনের অনত্মর্ভূক্ত প্রথা (পঁংঃড়স) লোকসমাজের মানুষের গোষ্ঠীকেন্দ্রিক বার্ষিক আমোদের, আনন্দেও অনুষ্ঠান- উত্‍সবের গুরম্নত্ব সাংস্কৃতিক, জাতিতাত্তি্বক৷ বার্ষিক আমোদ ও আনন্দকেন্দ্রিক উত্‍সবের যে প্রথা রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম নবান্ন, নববর্ষ এবং পৌষউত্‍সব, মেলা৷ এছাড়া ধর্মীয় ঈদ, মহরম, বিভিন্ন পূজা, চৈত্র সংক্রানত্মি উপলৰে আয়োজিত উত্‍সব মেলা৷ এসব দিনে উত্‍সব, মেলা আয়োজনের ঐতিহ্যিক প্রথা আমাদের লোকজীবনের ঐতিহ্য৷ এভাবেই গ্রামীণ লোকজীবন ধারার অবিচ্ছেদ্য অংশ লোকমেলা৷ প্রতি বছর নানা পাল-পার্বণে ধর্মীয় উত্‍সবকে ঘিওে আয়োজিত লোকমেলার রয়েছে লোকজীবনের আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক গুরম্নত্ব৷ লোকজীবন ধারার পরিচায়ক বস্তুজাত সংস্কৃতির বস্তু-লোক ও কারম্নশিল্পের প্রসার, উত্‍কর্ষ, যোগাযোগ, বাজার ও সমন্বয়ের ৰেত্র লোক মেলা৷ উপলৰ্য হিসেবে কখনো ধর্মীয়, কখনো কৃষিভিত্তিক জীবনের আচার অনুষ্ঠানগত রূপের পরিসীমায় মেলা আয়োজন করা হয়৷ এভাবেই মেলা একটি ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে৷
এছাড়া আবহমানকাল হতে বাংলাদেশের স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামীণ লোকজীবনের সার্বিক উন্নয়নকে মেলায় তুলে ধরা, ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা হয়৷ সেই সঙ্গে লোকসমাজের সকল সত্মরের বয়সের মানুষের মধ্যাকার একটি বাসত্মব যোগাযোগ, যার মধ্যে অনত্মর্ভূক্ত রয়েছে আর্থ- সামাজিক-সাংস্কৃতিক দিক৷ ফলে মেলা হয়েছে আমাদের দেশের গ্রামের সাধারণ মানুষের আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের কেন্দ্র এবঙ আবালবৃদ্ধবনিতা সকলের অতি পরিচিত, প্রাণের, জীবনের আনন্দের ৰেত্র৷ এভাবে গ্রামের সাধারণ মানুষের সস্কৃতির লালন, রূপানত্মরের ৰেত্রই বলা চলে মেলাকে৷
বাংলাদেশের মেলা এদেশের মানুষের গোষ্ঠীগত চেতনার নানা প্রাচীন অনুষঙ্গ, চিত্র, বৈশিষ্ট্য, বৈশিষ্ট্যেও নানা দিকের অজানা তথ্য, তত্ত্ব আবিষ্কারের অশেষ ৰেত্র৷ মেলা ধর্মীয় বা ধর্মনিরপেৰ যে ধরনেরই হোক না কেনো গ্রামীণ পরিবেশের মানুষের দ্বারা গঠিত গোষ্ঠির আশা আকাক্সখা, উন্নয়ন, মেলার চরিত্রকে নিয়ন্ত্রণ কওে থাকে৷ অর্থাত্‍ লোকসমাজের চাহিদার উপর ভিত্তি করেই মেলার চালচিত্র,বৈশিষ্ট্য সৃজিত হয়ে থাকে৷ জীবনের প্রাত্যহিকতাকে পরিপূর্ণ করতে একদিকে কৃষি উপকরণ, অপরদিকে দৰ হাতের তৈরি বস্তু, দ্রব্য-লোক ও কারম্নশিল্পের বিনিময়, লেনদেন মেলার একটি বড় কার্য়ক্রম৷
আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রেৰিতে লোকজীবনে ব্যক্তি মানুষের অবস্থান, চলার পথে মেলা এবং সামগ্রিক অগ্রগতি ও উন্নয়নকে অবলোকন করার আনুষ্ঠানিক আয়োজন হচ্ছে লোকমেলা৷ লোকসংস্কৃতির সাংস্কৃতিক উপাদান, অবস্থা বস্তুজাতসংস্কৃতি- লোক ও কারম্নশিল্পের প্রসার ও আদান প্রদানের ৰেত্র লোকমেলা বাংলাদেশের মানুষের লোকজীবনধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত৷
বাংলাদেশের লোকজীবন এদেশের প্রাকৃতিক পরিবেশের বৈশিষ্ট্য ও সীমারেখায় সৃষ্ট কৃষিব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল৷ লোকজীবন ধারার এই প্রধান বৈশিষ্ট্য নিয়েই এদেশের লোকসংস্কৃতি, বস্তুজাতসংস্কৃতির গড়ন, রূপ নির্ধারিত হয়েছে৷ গ্রামীণ কৃষিজীবন ভিত্তিক, লোকজীবনধারার প্রয়োজনীয় বস্তুজাতসংস্কৃতির লোক ও কারম্নশিল্প এদেশের প্রাকৃতিক পরিবেশের সহজলভ্য উপাদান, কাঁচামাল, উপকরণে তৈরি৷ লোকজীবন ধারায মানুষের জন্ম হতে মৃতু্য পর্যনত্ম যা কিছু প্রয়োজনীয় বস্তু-বস্তুজাতসঙস্কৃতি-লোক ও কারম্নশিল্পের অনত্মর্ভ্থক্ত৷ এর শ্রেণীকরণ এভাবে হতে পারেঃ
১. কৃষি কাজের সরঞ্জাম ঃ লাঙ্গল, বাঁশের ঝুড়ি, ধানের গোলা, ধান চাল মাপার বাঁশের, বেতের কাঠা, বাঁশের, বেতের মাথাল, ঢেকি, কুলা, বাঁশের খালই, ধামা৷
২. গার্হস্থ্য জীবনের প্রয়োজনীয় জিনিস ঃ মাটির হাঁড়ি, পাতিল, কলসি, শানকি, বাটি, গামলা, চাবি, কাঠের চামচ, তালপাতার ও বাঁশের-বেতের পাখা, বাঁশের ঝুড়ি, কাঠের বাক্স, পাটের সিকা, শীতলপাটি, হোগলা, মাদুর, শতরঞ্জী, প্রদীপদানী৷
৩. বাসস্থানের জন্য ঃ মাটির, বাঁশের, বাঁশ-ছনের ঘর৷ বাঁশের বেড়া, বেলকি, দরমা, কাঠের দরজা, জানালা, চৌকাঠ৷
৪. বস্ত্র পরিচ্ছদ ঃ সুতিবস্ত্র, শাড়ী, লুঙ্গী, ধুতি, নকশী কাঁথা, গামছা, ফতুয়া৷ এবং উপজাতি ও আদিবাসীদের পোশাক, পরিচ্ছদ৷
৫. যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রয়োজনে ঃ নৌকা, গরম্নর গাড়ী, পাল্কী৷
৬. মানুষের সৌন্দর্যবোধ সংক্রানত্ম ঃ বাঁশের বাশী, ঢোল, কারম্নকার্যময় কাঠের, বাঁশের জিনিস, একতারা, দোতারা, বাদ্যযন্ত্র৷
৭. শিশুদের আনন্দ বিধান ঃ মাটির পুতুল, বাঁশের, কাঠের খেলনা, হাতী, ঘোড়া, পুতুল, গরম্নর গাড়ী৷
৮. ধর্মীয়, লোকজ বিশ্বাস ঃ মাটির কাঠের তৈরী প্রতিমা, মূর্তি, কাঠের মূর্তি, মাটির তৈরী লৰীসরা৷ পাটি-জায়নামাজ, কোরানের গিলাফ, পটচিত্র৷
৯. সাধারণ আসবাব ঃ জলচৌকি, কাঠের পিড়ি, কাঠের বাক্স, কাঠের তাক, বাঁশের, বেতের বাক্স, ঝুড়ি৷
১০. অঙ্গের সাজ সজ্জা ঃ লোক অলঙ্কার, পুতির মালা৷
বাংলাদেশের লোকজীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ লোকজউত্‍সব, মেলা এদেশের বস্তুজাত সংস্কৃতি-লোক কারম্নশিল্পের কেন্দ্র৷ এই ঐতিহ্য আমাদের সংস্কৃতির ঐতিহ্য৷ অর্থাত্‍ হাজার বছর ধরে বাংলাদেশের বস্তুজাত সংস্কৃতি লোক কারম্নশিল্পের বিক্রয় ও প্রসারের কেন্দ্র লোকজ উত্‍সব, মেলা৷ লোকজ উত্‍সব ও মেলা যেমন আমাদের সাংস্কৃতিক উপাদান এবং সেই সঙ্গে এক ধরনের সাংস্কৃতিক অবস্থাও বটে৷ বস্তুজাতসংস্কৃতি-লোককারম্নশিল্প আমাদের দেশের লোকজীবনধারা- সংস্কৃতির অবকাঠামো সৃষ্টির কাজটি কওে থাকে৷ সেই সঙ্গে লোকজীবনধারা-লোকসংস্কৃতির বাকজাতীয় সাংস্কৃতিক উপাদান-সংস্কৃতির উপরিকাঠামোকেও যুগপত্‍ ধারণ করে৷ জাতীয়সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, এর স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে বস্তুজাতসংস্কৃতির-বস্তু লোককারম্নশিল্পের মূল্য, গুরম্নত্ব অপরিসীম৷ বস্তুতঃ বস্তুজাতসংস্কৃতি লোককারম্নশিল্প লোকসমাজের মানুষের লোকজীবনধারা-লোক সংস্কৃতিকে ধারণ করে৷ এজন্য বস্তুজাতসংস্কৃতির বস্তু, লোককারম্নশিল্প জাতিতাত্তি্বক৷ এর বিশেস্নষণ ও মূল্যায়নের জন্য প্রথমে বস্তুজাতসংস্কৃতির অনত্মর্ভূক্ত বস্তু লোককারম্নশিল্পের অসংখ্য নমুনার দলিলীকরণ করা অপরিহার্য৷ আঞ্চলিক-স্থানিক, ও কালিক ব্যবধানে বহু বিচিত্র ধরনের অসংখ্য বস্তুজাতসংস্কৃতি-লোককারম্নশিল্প ক্রমাগত সাংস্কৃতিক রূপানত্মর প্রক্রিয়ায় রূপানত্মরিত হয়ে চলমান, অব্যাহত রয়েছে৷ বাংলাদেশের ঐতিহ্যের লোক জীবনধারায় আজ অবধি ক্রমপুঞ্জিত ভাবে রূপানত্মরিত ধারাবাহিক রূপকে বস্তুজাতসংস্কৃতির বস্তু, লোককারম্নশিল্প ধারণ কওে সচল, অব্যাহত রয়েছে৷
লোকজউত্‍সব ও মেলায় বস্তুজাতসংস্কৃতি-লোককারম্নশিল্পের উলিস্নখিত লোকজীবনধারাকেন্দ্রিক দৈনন্দিন ব্যবহার্য বহু বিচিত্র জিনিস কেনা বেচা, লেনদেন হয়ে থাকে৷ এই নিয়ম ও ধারাটিও আমাদের লোকসাংস্কৃতির ঐতিহ্যের প্রথা, রেওয়াজ এবং সংস্কার৷ আবহমান কাল হতে আজ অবধি আমাদেও দেশের ধর্মনিরপেৰ বা ধর্মীয় সকল উত্‍সব, মেলায় এক এবং অভিন্ন ঐতিহ্য অনুসৃত হচ্ছে৷ এবং লোকজউত্‍সব, মেলা আমাদের লোকসমাজের লোকজীবনধারার সাংস্কৃতিক পরিচয়বাহী বস্তুজাতসংস্কৃতি-লোককারম্নশিল্পের প্রদর্শন, প্রসার বাজারের আদর্শ কেন্দ্র৷ বাংলাদেশের লোকজীবনধারা-লোকসংস্কৃতির প্রবহমান ধারাটি এখনো এদেশের গ্রামের মানুষের অনুভব চেতনায়, জীবনযাপনে সক্রিয়৷ ফলে লোকজীবনধারা-লোকসংস্কৃতির তাগিদ, প্রথা, নিয়ম, রেওয়াজ লোকজউত্‍সব মেলাকে একটি সংস্কার হিসেবে আবহমান কাল হতে আজ অবধি আয়োজন করা হয়৷ লোকজউত্‍সব, মেলার এই আয়োজন ঐতিহ্যিক ধারার পাশাপাশি স্থানিক ও কালিক ব্যবধানে নবনব রূপে লোকজ উত্‍সব, মেলা আমাদেও জাতীয় সাংস্কৃতিক পরিন্ডলে রূপলাভ করে চলেছে৷