প্রাগৈতিহাসিক যুগ হতে আমরা মানুষের শিল্পচেতনার পরিচয় পাই। সে সময়ে মানুষ শিল্পকর্মের জন্ম দিয়েছিলো ঠিকই তবে তার ধরনটা ছিলো আলাদা। এ সময়ের শুরুতে মানুষ শিল্প সৃষ্টি করেছিলো প্রতিনিয়তঃ যুদ্ধ করে নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখবার জন্য। প্রগৈতিহাসিক যুগে মানুষকে জীবন ধারনের জন্য, খাদ্য সংগ্রহের জন্য জীবজন্তু শিকার করতে হতো। আর মূলতঃ এসব জীবজন্তুর ছবিই তারা এঁকেছে। আর এখান হতেই শুরু হয়েছিলো প্রগৈতিহাসিক শিল্পকলার ইতিহাস।
মানুষের আদিম বন্যদশা হতে সভ্যতার উত্তরণের পথটা ছিলো বন্ধুর। প্রতিকূল অবস্থা অতিক্রম করে তাকে পদে পদে নানা কষ্ট সহ্য করে এগুতে হতো নতুন কিছু উদ্ভাবন করতে।
পৃথিবীতে আগমনের পর হাজার বছর ধরে মানুষ শিকার করে জীবন ধারন করেছে। উৎপাদনের কৌশল রপ্ত করতে পারেনি বলে বুনো জন্তু শিকার করেছে পাথরের হাতিয়ারের সাহায্যে। এই সময়কে পাথর যুগ নামে অভিহিত করা হয়।
পাথরযুগকে প্রধানতঃ দুটি ভাগে ভাগ করা যায়-
১.প্যালিওলিথিক (পুরান প্রস্তর যুগ বা পুরাপলীয় যুগ)
২.নিওলিথিক (নব্য প্রস্তর যুগ)
এছাড়াও এ দুটি যুগের মধ্যবর্তী সময়ে তৃতীয় আরও একটি যুগের নাম দেয়া হয়েছে-
৩.মেসোলিথিক (মধ্যপলীয় যুগ)
প্যালিওলিথিক (পুরাপলীয় যুগ) : পুরা অর্থ প্রাচীন এবং উপল অর্থ পাথর আর এ দুটো শব্দের সমন্বয়ে হয়েছে পুরাপলীয় শব্দ। এ যুগে মানুষ তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে শিকারি কার্য়কলাপ চালিয়েছে পাথরের হাতিয়ারের মাধ্যমে।
তাই সমগ্রভাবে শিকারী যুগকে পুরালীয় যুগ বলা হয়। তবে সাধারনভাবে বলা চলে পুরাপলীয় যুগের শিকার ব্যবস্থাই ছিলো পৃথিবীর সব অঞ্চলের মানব সমাজের মূল ভিত্তি।
পুরাপলীয় যুগে মানুষ তাদের ধ্যান ধারনা ও জীবনের অভিজ্ঞতাকে চিত্রকলা ও ভাস্কর্যের মাধ্যমে রূপ দেয়ার চেষ্টা করেছে। এ যুগের শেষ পর্বে অর্থাৎ উচ্চ পুরাপলীয় যুগের গুহাবাসী শিকারী মানুষরা গুহার দেয়ালে ছবি এঁকেছে। আর এগুলোই হচ্ছে চিত্রকলার আদি নিদর্শন। তবে শিল্পকলার ইতিহাসে এই গুহাচিত্রগুলো আদি চিত্রকলার নিদর্শণ হিসেবে বিশেষ গুরুত¦ বহন করে।
এ যুগের মানুষের বাস্তবতা এবং তাদের আঁকা চিত্রের মধ্যে কোনো পার্থক্য নির্ণয়ে প্রয়াসী হয়নি। তার কাছে অঙ্কিত বস্তুটি ছিলো বাস্তব। বস্তু বা প্রাণীর অবয়ব সৃষ্টির পেছনে যে কারনটি কাজ করেছিলো তা হলো সে আকাঙ্খিত বস্তুটিকে পাওয়ার ইচ্ছা। এটিকে যাদুবিশ্বাস বলা হয়। নির্দিষ্ট কোনো পশুকে বধ করার ইচ্ছা বা কোনো শত্রুর প্রাণনাশের ইচ্ছা হতে এই যাদুবিশ্বাসের উদ্ভব। তবে একথা মনে করা হয় যে যাদুবিশ্বাস হতেই ধর্মের সৃষ্টি।
পুরানপ্রস্তর যুগে ভাস্কর্যের বেশ কিছু নিদর্শন মেলে। এগুলোর মধ্যে উৎপাদিকা শক্তির প্রতিকরূপে কিছু মাতৃকামূর্তি উল্লেখযোগ্য। সাধারনত এই সেই নগ্ন নারী মুর্তিগুলি অত্যন্ত স্থূলাঙ্গী, বক্ষ ও নিতম্ব বিশাল, মাংসল শিথিল, যাকে ইউরোপীয়রা সাধারন নাম দিয়েছে ভেনাস। গর্ভধারিনী এসব মাতৃমুর্তিগুলি গর্ভোন্মেষ প্রকাশের ক্ষেত্রে ছিলো আবেদনময়।
পুরাপলীয় যুগের বিখ্যাতএকটি মুর্তির নাম - ভেনাস অফ উইলেনডর্ফ ( খৃঃ ২৮০০০ - ২৩০০০ খৃঃ পূঃ লাইমস্টোন,৪’১/৪” উচ্চতা )
নিওলিথিক (নব্য প্রস্তর যুগ) : আনুমানিক আট হতে দশ হাজার বছর আগে মানুষ কৃষিকাজ আবিষ্কার করার পর তৎকালীন সমাজের আরো উন্নতি হয়। এ সময় মানুষ আরো উন্নত এবং মসৃন পাথরের হাতিয়ার ব্যবহার করতে শুরু করে। কৃষি আবিষ্কারের পর এই যুগকে নাম দেয়া হয়েছে নিওলিথিক (নব্যপ্রস্তর যুগ)।
নব্যপ্রস্তর যুগে মানুষ যাযাবর জীবন পরিত্যাগ করে কৃষিভিত্তিক স্থায়ী জীবনে অভ্যস্থ হতে শুরু করে। এ সময়ে মানুষ পশু শিকারের চাইতে পশু পালনের দিকে বেশী আগ্রহী হয়।
নব্যপ্রস্তর যুগেই আমরা প্রথম স্থাপত্য কর্মের নিদর্শন লক্ষ্য করি। এগুলোকে অবশ্য যথার্থ স্থাপত্য কর্ম বলা যায় না। তবে স্থাপত্যকর্মের আদিরূপ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। এ সময়ে নির্মিত স্থাপত্য কর্মের মধ্যে রয়েছে -
ডলমেন : নব্যপ্রস্তর যুগে নির্মিত প্রাচীন স্মৃতিস্তম্ভের উদাহরন। এটির নির্মানশৈলীতে রয়েছে সমাধির চারপাশে কতগুলো পাথর রাখা হতো। আর একখানা বড় পাথর দিয়ে উপরিভাগ ঢেকে দেয়া হতো। এই সমস্ত ডলমেন আবিষ্কৃত হয়েছে বিশাল এলাকা জুড়ে । ইংল্যান্ড, স্পেন প্রভৃতি অঞ্চলে এগুলি আবিষ্কৃত হয়েছে। এগুলির গুরুত্ব এজন্যই যে ডলমেনকে আমরা মানব সভ্যতার প্রাথমিক স্তরের স্থাপত্য হিসেবে চিহ্নিত করতে পারি। মানুষ এগুলির উপর ভিত্তি করেই নির্মান করেছিলো প্রথম স্থাপত্যের নিদর্শনাবলী।
স্টোনহেঞ্জ (খৃঃ পূঃ ২০০০ অব্দ) : নব্যপ্রস্তর যুগে আবিষ্কৃত আরো একটি স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শন স্টোনহেঞ্জ - যা ইংল্যান্ডে অবস্থিত। বিশাল বিশাল পাথর খন্ডকে অল্প ব্যবধানসহ দাঁড় করিয়ে তাদের মাথায় পাথর বসিয়ে দেয়া হতো। অধুনা পন্ডিতগন মনে করেন যে, এ সমস্ত স্টোনহেঞ্জ জ্যোতির্বিদ্যার কাজে ব্যবহৃত হতো।
আজকের পৃথিবীতে যে মানুষ বাস করছে এ জাতের মানুষের আবির্ভাব পৃথিবীতে ঘটেছিলো চল্লিশ হতে পঞ্চাশ হাজার বছর আগে। তার আগের অন্য এক অসম্পূর্ণ মানুষ হতে বিবর্তনের মাধ্যমে আধুনিক মানুষের উদ্ভব হয়েছিলো এবং তা ছিলো এক দীর্ঘকাল ব্যাপি প্রক্রিয়া।
মানুষের ইতিহাস বলতে তার রূপান্তরের, তার প্রগতিশীল বিকাশের বিবরনকেই বোঝায়। ক্রমবিকাশের ধারাবাহিকতায় মানুষ প্রথমে বন্যদশা ও পরে বর্বরদশা অতিক্রম করেছে, তারপর ঘটেছে সভ্যতার সূত্রপাত।
মানুষের এই বিবর্তনকে কয়েকটি পর্যায়ে ভাগ করা যায় :
১.প্রাইমেট
২.অষ্ট্রালোপিথেকাস
৩.খাড়া মানুষ
৪.নিয়ান্ডার্থাল মানুষ
৫.হোমো স্যাপিয়েন বা বুদ্ধিমান মানুষ
প্রাইমেট : প্রায় ৪-৫ কোটি বছর আগে এক জাতের স্তন্যপায়ী প্রাণী গাছে বাস করার ফলে ঐ পরিবেশের উপযোগী কতগুলো গুন অর্জন করেছিলো যা ভ’মিচর প্রাণীদের পক্ষে লাভ করা সম্ভব হয়নি। এ জাতের প্রাণীদের বলা হয় প্রাইমেট। গাছের ডালে বাস করার ফলে প্রাইমেটদের মাংসপেশী, ইন্দ্রিয় ও স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশ ঘটেছে। পরিবেশ হতে সহায়তা পাওয়ার ফলে প্রাইমেটরা কালক্রমে বড় মগজের অধিকারী হয়েছে। অতীতকালে প্রাইমেটদের একটি শাখা হতে বিবর্তনের মাধ্যমে ক্রমে ক্রমে মানুষের উৎপত্তি হয়েছে।
অষ্ট্রালোপিথেকাস : পরবর্তীতে উন্নততর এক প্রাইমেটের ফসিল পাওয়া যায় দক্ষিন আফ্রিকায়। এদের নাম দেয়া হয়েছে অষ্ট্রালোপিথেকাস। শব্দটির অর্থ দক্ষিনের নরবানর। কিন্তু আসলে এরা নরবানর ছিলো না। এদের দাঁত ছিলো ছোট আর কোমরের হাড়, হাত, পা, চোয়াল ইত্যাদি ছিলো প্রায় মানুষের মতো। তবে তার মস্তিষ্কের আয়তন ছিলো আধুনিক মানুষের প্রায় অর্ধেক।
খাড়া মানুষ : তাঞ্জানিয়ার হ্রদের পাড়ের আধা-মানুষদেরও বিবর্তন ঘটতে থাকে এবং আট-দশ লক্ষ বছর আগে আফ্রিকাতেই আরেক নতুন ধরনের মানুষের উৎপত্তি ঘটে। এদের নাম খাড়া মানুষ। এরা খাড়া হয়ে চলতে পারতো। এ মানুষের সময়ে তার আশেপাশে ছিলো আশ্চর্য সব জš-জানোয়ার। আর এ পরিবেশে বেচে থাকার জন্য মানুষকে আরো বেশী চালাক, চতুর ও দক্ষ শিকারী হতে হয়েছে। এদের হাতিয়ার ছিলো উন্নত ধরনের। আর এদের মগজও ছিলো বড়। খাড়া মানুষদের থুতনি বা কপাল বলতে কিছু ছিলো না, এদের ভুরুর খাজ ছিলো গভীর আর চোয়াল ছিলো বেশ বড়। দাঁত ও হাত-পা গুলো ছিলো মানুষের মতই।
নিয়ান্ডারথাল মানুষ : জামৃানীর নিয়ান্ডারথাল নামক স্থানে এক জাতের মানুষের কঙ্কালের সন্ধান পাওয়া গেছে। এই জায়গার নামানুসারে এ জাতের মানুষের নাম দেয়া হয়েছে নিয়ান্ডারথাল মানুষ।
নিয়ান্ডারথাল মানুষ ছিলো দৈহিক শক্তির অধিকারী এবং দক্ষ শিকারী। আগুন এবং হাতিয়ার তারা আয়ত্ত্ব করেছিলো। এ জাতের মানুষ বহু রকমের পাথরের হাতিয়ার তৈরী করতে পারতো। এরা মৃত মানুষের কবর দিতো। মানুষের ইতিহাসে এটা এক নতুন ঘটনা।
হোমো স্যাপিয়ান : চল্লিশ হতে পঞ্চাশ হাজার বছর আগে ইউরোপ এক নতুন ধরনের শিকারী মানুষের আবির্ভাব হয়। এদের কপাল ছিলো চওড়া, ভুরু মসৃন – এরাই আধুনিক মানুষ। বর্তমান পৃথিবীতে শুধুমাত্র এ জাতের মানুষই আছে। এ আধুনিক মানুষের নাম দেয়া হয়েছে হোমো-স্যাপিয়েন।
মেসোপটেমিয়া একটি গ্রীক শব্দ। এর অর্থ দুই নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চল। এই দুই নদী বলতে টাইগ্রিস এবং ইউফ্রেটিসকে বোঝানো হয়েছে।
প্রাচীন সভ্যতার দিক হতে মিশরের পর মেসোপটেমিয়ার নাম করা যায়। তবে মিশর এবং মেসোপটেমিয়া সভ্যতা সমসাময়িক বলে ধারনা করা হয়। এ সভ্যতাকে আগে ব্যবিলনীয় বা ব্যবিলনীয় আসিরীয় নামে আখ্যায়িত করা হতো। মেসোপটেমিয়ার উত্তরাংশের নাম আসিরিয়া ও দক্ষিনাংশের নাম ব্যবিলনীয়া। ব্যবিলনিয়ার দুটি অংশ - দক্ষিনে সুমের ও উত্তরে আক্কাদ। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল হতে মানুষ এখানে এসে আবাস গড়ে তুলেছিলো। নব্যপ্রস্তর যুগের যাযাবর মানুষ আশ্রয়ের সন্ধানে এখানে এসে উপস্থিত হয়। সুমেরীয় ব্যবিলনীয় কাসাইট, আসিরীয়, ক্যলিডীয় প্রভৃতি জাতির অবদানে দীর্ঘকাল এ সভ্যতা সমৃদ্ধ হয়েছিলো। তাই সামগ্রিকভাবে এ সভ্যতাকে মেসোপটেমিয়া সভ্যতা বলাই অধিক যুক্তিযুক্ত।
মেসোপটেমিয়ায় প্রথমে যারা সভ্যতার গোড়াপত্তন করে তারা সুমের জাতি। সুমের জাতি কয়েকটি নগরীর গোড়াপত্তন করে। সুমেরের পরে আসে আক্কাদ জাতি। আক্কাইদ জাতির পর আমেরাইট জাতির আবির্ভাব ঘটে। আমেরাইট জাতির বিখ্যাত সম্রাট ছিলেন হাম্বুরাবি। তার রাজধানীর নাম ছিলো ব্যবিলন। আমেরাইটের পরে মেসোপটেমিয়ায় আগমন করে আসিরীয় জাতি।
মেসোপটেমিয়ায় জাতিসত্ত্বার গোড়াপত্তন : মেসোপটেমিয়ার পলিমাটি পড়া টাইগ্রিস এবং ইউফ্রেটিস নদী বিধৌত অঞ্চলই ছিলো খুব উর্বর। এ অঞ্চলে খাদ্যের প্রাচুর্য যাযাবর গোষ্ঠীর স্থিতিশীলতা এনে দেয়। ক্রমে জনসংখ্যাও বেড়ে যেতে থাকে। এখানকার আবহাওয়া সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলবার সহায়ক ছিলো। এ অঞ্চলের মানুষ মৃত্যু পরবর্তী জীবন নিয়ে বিশেষ ভাবেনি। তারা বুঝতো পার্থিব জীবনের সুখ আর আনন্দ। তারা যুদ্ধ ও শিকার করতে ভালোবাসতো। মেসোপটেমিয়ায় তাই শিকার ও যুদ্ধের প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষ্যনীয়।
সুমেরীয় শিল্পকলা : মেসোপটেমিয়ায় প্রথমেই যারা সভ্যতার গোড়াপত্তন করে, তারা সুমের জাতি। টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস এই দুটি নদী বেষ্টিত সুমের ছিলো কাদামাটির অঞ্চল। সুরক্ষিত শহর নির্মানে তারা ছিলো দক্ষ।
সুমেরিয়ান সংস্কৃতির একটি বিরাট বিষয় হলো জিগুরাট। অর্ম মন্দিররূপে জিগুরাতের অবস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চতুষ্কোন ভিতই এর প্রধান বৈশিষ্ট্য। প্রথম জিগুরাত নির্মিত হয়েছিলো উড় নামক শহরে। এটি সাদা মন্দির নামে খ্যাত। জিগুরাত নির্মানে সাধারনতঃ উপকরন হিসেবে রোদে পোড়া ইট ব্যবহৃত হত।
ভাস্কর্য নির্মানে সুমেরীয়রা দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। সুমেরীয়ান ভাস্কর্যের বৈশিষ্ট্য বড় বড় চোখ ও সিলিন্ডার আকৃতির দেহ পরিলক্ষিত হয়। খৃঃ পূঃ ৩৫০০ অব্দে মার্বেল পাথরে নির্মিত নারী মুর্তিটি অসম্ভব অভিব্যক্তিময়। এর ঠোঁট ও চিবুকের স্নিগ্ধ সৌন্দর্য চোখে পড়ে।
সুমেরীয়ান ভাস্কর্যের মধ্যে অন্যতম টেল-আসমারে আবুর মন্দির হতে উক্ত পুজারীদের কতগুলি মুর্তি। মুর্তিগুলির সবকটি উপাসনার ভঙ্গিতে দন্ডায়মান। এগুলি ঘাঘরা সদৃশ পোষাক পরিহিত। পুরুষ মুর্তির লম্বা ও কুঞ্চিত চুল ও দাড়ি সম্পূর্ণ কামানো।
আক্কাদীয় শিল্পকলা : দক্ষিন মেসোপটেময়ায় উরুক যুগের প্রথম দিকে সুমেরীয়রা আসে। সেই সময় বা তারও পূর্ব হতে টাইগ্রিস নদীর উচ্চ অববাহিকা অঞ্চলে সেমেটিক জাতির মানুষের বাস ছিলো যারা কালক্রমে আক্কাদীয় সম্রজ্যের প্রতিষ্ঠা করে। রাজা সারগন ছিলেন এই সম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। বিভিন্ন ভাস্কর্য হতে আক্কাদীয়দের আকৃতি সম্বন্ধে ধারনা করা যায়। তাদের মুখে সাধারনতঃ দাঁড়ি ও মাথার চুল ঘাড় পর্যন্ত লম্বা ছিলো।
আক্কাদিয় যুগের স্থাপত্য সম্বন্ধে খুব বেশী তথ্য আবিষ্কৃত না হলেও বহু ভাস্কর্যের নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। ভাস্কর্যগুলো সাধারনতঃ ব্রোঞ্জ ও পাথর দিয়ে তৈরী হতো যা ছিলো খুবই উন্নত। ভাস্কর্যগুলোর রূপ ছিলো পার্থিব।
খৃঃ পূঃ ২২০০ অব্দে নির্মিত আক্কাদীয় শাসকের ব্রোঞ্জ মুর্তিটি এ সময়ের শিল্পকলার একটি উল্লেখযোগ্য নিদর্শন। এর মুখের অভিব্যক্তিতে ছিলো আতœপ্রত্যয় ও পৌরুষদীপ্ত ভাবের প্রকাশ। এর মুখে ছিলো লম্বা দাঁত, চুল ঘাড়ের কাছে বাঁধা, চোখের গর্তে পাথর বসানো।
মার্গনের পুত্র নরমইসনের বীরত্ব কাহিনী বর্ণিত পাথরের একটি খন্ড আক্কাদীয় শিল্পের বিশিষ্ট উদাহরন (ভিক্টরিস টেল অফ নরম সিন ফ্রম সুসু, ২২০০খৃঃ পূঃ, পিঙ্ক, স্যান্ডস্টোন). এই খন্ডটি প্রায় ৭৫ ফুট উঁচু। এর গায়ে যুদ্ধ দৃশ্য উৎকীর্ণ। এতে রাজা নারামসিন তীর ধনুক হাতে পাহাড়ে উঠছেন সৈন্যদল নিয়ে। রাজাকে এখানে বড় করে দেখানো হয়েছে যা মিশরীয় শিল্পকলার অনুরূপ।
নিও সুমেরিয়ান শিল্পকলা : উত্তর পূর্ব দিক হতে আগত গুটি নামে এক বর্বর জাতির আক্রমনে আক্কাদীয় সাম্রাজ্যের পতন হয়। এ জাতির একজন শাসকের নাম ছিলো গুতিয়া। তার অসংখ্য ভাস্কর্য নির্মিত হয়েছিলো। এগুলোর বেশীর ভাগই দাড়ানো বা উপষ্টি অবস্থায়।
খৃঃ পূঃ ২১০০ অব্দে উপবিষ্ট অবস্থায় রাজা গুতিয়ার একটি ভাস্কর্য পাওওয়া যায় যা কঠিন ডিওরাইট পাথরে তৈরী। এতে রাজাকে একজন পূজারীরূপে দেখানো হয়েছে।
ব্যাবিলনীয় শিল্পকলা : সুমেরীয়দের পতনের পর আমেরাইট জাতি সুমের ও আক্কাদ জয় করে ব্যাবিলনীয় সভ্যতা গড়ে তোলেন। আমেরাইটদের নিজের সংস্কৃতি বিশেষ উন্নত ছিলো না, তারা মেসোপটেমিয়ার সম্রাজ্য পতন করে সুমেরীয়দের সভ্যতা সংস্কৃতিকেই গ্রহন করেছিলো। খৃঃ পূঃ ১৭৯২ - ১৭৫০ অব্দের মধ্যে ব্যবিলনের রাজা হাম্বুরাবি গোটা মেসোপটেমিয়াকেই ব্যবিলনের এককেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থার অধীনে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। তার সাম্রাজ্য বিরাট ছিলো।
আসিরিয় শিল্পকলা : টাইগ্রিস নদীর উচ্চ ববাহিকা অঞ্চলে বহু প্রাচীনকাল হতে একটি জাতি বাস করতো। তাদের প্রধান দেবতা ছিলো অসুর। অসুর দেবতার নামানুসারে সেই জাতি আসিরিয় নামে পরিচিত।
মেসোপটেমীয় অন্যান্য নির্মাণের মতো আসেরীয়রাও নির্মানের উপকরন হিসেবে কাদামাটির ইট ব্যবহার করতো। এ সময়ের অধিকাংশ ভাস্কর্যই ছিলো রিলিফ ভাস্কর্য। এ সময়ের ভাস্কর্যগুলোতে হিংস্রভাব প্রকাশ পেয়েছে। মানুষের সমস্ত সুকোমল বৃত্তিকে নির্মাতিত করে আসিরীয় সম্রাটগন রাক্ষুসে বা রক্তলোলুপ ভাবটিকে তীব্রভাবে প্রকাশ করার জন্য যেন শিল্পীদের নিযুক্ত করেছিলেন। ভাস্কর্যগুলোর অভিব্যক্তিতে কঠোর ও অনমনীয় ভাব। এসব ভাস্কর্যের অভিব্যক্তিতে প্রকাশ পেয়েছে উদ্ধত প্রকৃতির শাসকের ক্ষমাহীন বা নির্মম ভাব।
আসিরীয়রা ছিলো মহাপরাক্রান্ত এবং রণকৌশলে নিপুন। আসিরীয় সম্রাটগন যুদ্ধক্ষেত্র এবং শিকারের কাহিনীকে তাদের কলাকৌশল এবং বীরত্বের কাহিনীকে প্রাসাদের গায়ে ভাস্কর্য ও চিত্রকলার মাধ্যমে রূপদিতে শিল্পীদের নির্দেশ দেন। তাই যুদ্ধক্ষেত্র এবং শিকারের দৃশ্যপট আসিরীয় শিল্পের মুল উপজীব্য।
আসিরীয়ান ভাস্কর্যের অন্যতম নিদর্শন মেলে খৃঃ পূঃ ৭২০ অব্দে। এ সময়ে নির্মিত ভাস্কর্য লামাস্সু তে অদ্ভুত আকৃতি লক্ষ্যনীয়। এর মুখমন্ডল মানুষের মতো এবং দেহকানেডর আকার সিংহের মতো। পিঠের উপরে ঈগলের পাখাযুক্ত।