ম্যানারিজমের অর্থ বিশেষ রীতি নীতি। ইতালীয়ান শব্দ ম্যানিয়েরা হতে ম্যানারিজমের উৎপত্তি। ইতালীয়ান শিল্পী ভাসারী প্রথম এই শব্দটি ব্যবহার করেন।
হাই রেনেসাঁর পর অর্থাৎ ষোড়শ শতাব্দীতে ইতালীতে বিশেষ বৈশিষ্ট্যধর্মী শিল্পরীতির চর্চা চলে - যা ম্যানারিজম নামে পরিচিত। আনুমানিক ১৫২০ খৃঃ হতে ১৬০০ খৃঃ পর্যন্ত এর সময়কাল।
শিল্পী মাইকেল এঞ্জেলোকে ম্যানারিজমের জনক বলা হয়। তার আঁকা “দ্যা লাস্ট জাজমেন্ট” চিত্রটিতে প্রথম ম্যানারিজমের বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। ম্যানারিজম শিল্পীরা মূলতঃ হাই রেনেসাঁর বিখ্যাত শিল্পীদের কাজ সরাসরি অনুকরন করতে শুরু করেন, তাদের কাজের বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলো। বিশেষ করে শিল্পী মাইকের এঞ্জেলোর কাজগুলো। ম্যানারিজম শিল্পীরা প্রকৃতির কাছ হতে শিক্ষা গ্রহন না করে তাদের পূর্ববর্তী কালের শিল্পী অর্থাৎ হাই রেনেসাঁ যুগের শিল্পীদের শিল্পকর্ম হতে শিখতে শুরু করেন। রেনেসাঁর প্রতিক্রিয়ার ফলস্বরূপ এ সময়কার শিল্পীরা চাইলেন ওল্ড মাস্টারের কাজকে আজ্ঞা করে নতুন কিছু সৃষ্টি করতে। যার পরিনতি শিল্পীদের প্রথম স্বাধীনতার স্বাদ দিতে সমর্থ হয় ম্যানারিজম শিল্পশৈলী। ম্যানারিজম কে তাই ফার্স্ট ইন্টেলেকচুয়াল আর্ট বলা হয়।
ম্যানারিজম শিল্পমৈলীর উৎপত্তি হয়েছিল হাই রেনেসাঁর পর শিল্পের জগতের শূন্যতা পূরনের জন্য। এই শূন্যতা পূরনের জন্য ম্যানারিজম শিল্পীরা পূর্ববর্তী শিল্পীদের কাজের বিশেষ কিছু ম্যানারকে প্রাধান্য দিতে তাদের কাজে এনেছিলেন পূনরাবৃত্তি। আর এ পূনরাবৃত্তি করা হতো সচেতনতার সাথে।
বর্তমান কালের পন্ডিতেরা ম্যানারিজমের যুগকে সংস্কারমুক্ত হয়ে বোঝার চেষ্টা করছেন। পূর্বে মানুষ একে সাংস্কৃতিক অবক্ষয় বলে মনে করতো। তারা বলতো যে ম্যানারিস্ট শিল্পীরা রেনেসাঁস যুগের সৃষ্টিকে ব্যর্থ অনুকরন করেছিলেন এবং আকৃতিকে অতিরঞ্জিত করতে গিয়ে কৃত্রিমতার আমদানী করেছেন। সপ্তদশ শতাব্দীর নিত্ত ক্লাসিকাল শিল্পানুরাগী পন্ডিতেরা ম্যানারিজম সম্বন্ধে এই ধারনা পোষন করতেন বলে মানুষের মনে এলো সংস্কার। কিন্তু ম্যানারিজম শব্দটির ভাবার্থ পাওয়া যায় শিল্পী ভাসারীর লেখা হতে। ম্যানার শব্দ হতে এর উৎপত্তি ইতালীয় ভাষায় যাকে বলে ম্যানিয়েরা। শিল্পীর ভাবপ্রকাশের পন্থা প্রভাবিত হয় ঐতিহাসিক কারনে বা তার আপন ব্যক্তিসত্তা দ্বারা বা আঙ্গিক দ্বারা এই হতে সৃষ্টি হয় স্টাইল। ভাসারীর ব্যবহৃত ম্যানিয়েরা শব্দটি এরই ইঙ্গিত বহন করে।
ষোড়শ শতকে ইতালীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয় এবং ধর্মীয় ক্ষেত্রে ক্যাথেলিক ও প্রোটেষ্টান্ট মতাদর্শগত দ্বন্দ্ব মানুষের মনে আনে গভীর সংশয় - এলো তার অস্তিত্বের সংকট এবং এই চিন্তা হতে এলো ম্যানারিজমের জন্ম। ফরাসী ও স্প্যানিশ সেনাদল ইতালী জয় করে ষোড়শ শতকের প্রথমার্ধে। অবাধ লুন্ঠনে ক্ষতিগ্রস্থ হয় রোম। অর্থনীতিক ক্ষেত্রে ইতালীর প্রাধান্য চলে যায়। স্পেন ও ফ্রান্সের অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙ্গে গেলে ইউরোপের অন্যান্য দেশেও তার প্রভাব পড়ে। অন্যদিকে মার্টিন লুথার প্রবর্তিত ধর্মসংস্কার আন্দোলন ক্যাথলিক শিবিরে প্রবল আঘাত হানে। অনিশ্চয়তার মধ্যে মানুষের মনের ভারসাম্য হারিয়ে গেলে মানুষ তখন চাইলো কোনো অবলম্বন ধরে থাকতে। উত্তরনের পথ কোথায় ? উদ্বিগ্ন হয়ে ক্ল্যাসিকাল শিল্পের ভাষাকে শিল্পী চাইলেন হৃদয়ে ধারন করতে, চাইলেন অন্তত তাকে অনুকরন করতে। কিন্তু মনের গভীরে অস্বচ্ছ ছন্দ থাকায় ক্ল্যাসিকাল আদর্শের যথার্থ রূপায়ন সম্ভব হলো না। ক্ল্যাসিকাল শিল্পের প্রশান্তি, আবেগ ও যুক্তির ভারসাম্য এবং আকৃতির দৈহিক অনুপাতের সঙ্গতি বজায় রইলো না। যুক্তিবাদকে অতিক্রম করে গেলো মধ্যযুগীয় খৃষ্টান ভাববাদ - প্রকাশ পেলো অনুভূতির তীব্রতা ও আধ্যাতিকতা। মাইকেল এঞ্জেলোর শেষ জীবনের সৃষ্টি এবং তিনন্তোরেত্তোর চিত্রকলার সনাক্তচিহ্ন বহন করে এবং তাদের রচনা হতে ম্যানারিজমের সূত্রপাত। পার্মি জানিনো তার ছবিতে আকৃতি গুলিকে দীর্ঘায়িত করলেন এবং পরিসরে স্বাভাবিক ত্রিমাত্রিক বৈশিষ্ট্যকে কাটিয়ে দিতে চাইলেন। পনান্তর মোর অঙ্কিত চিত্রে আকৃতিগুলির আউটলাইন স্পন্দিত হলো ও হ্রাস পেলো দৈহিক ঘনত্ব। রসসোর ছবিতে ফুটে উঠলো তীব্র নাটকীয়তা। ফরাসী ম্যানারিস্টদের ছবিতে আকৃতির দেহ হলো ক্ষীন ও দীর্ঘায়িত, মাপ ছোট হয়ে এক পাশে একটু হেলে গেলো, নয়ন ভরে উঠলো ভাবাবেগে এবং হাতে প্রকাশ পেলো আবেগতাড়িত কম্পন।
তবে ম্যানারিস্ট শিল্পীরা রাফায়েল ও মাইকেল এঞ্জেলোর শিল্পকর্মগুলোকে অনুসরন করে চিত্র অঙ্কন করলেও উক্ত শিল্পীদের চিত্রে যে বাস্তবতা ছিলো তাদের ছবিতে তার অভাব ঘটে।
ম্যানারিজম শিল্পীদের চিত্রে বিশেষ যে বৈশিষ্ট্যগুলো লক্ষ্যনীয় :
১) চিত্রে ফিগারের বিশেষ পরিবর্তন। এগুলো হতো দীর্ঘ বা মোচড়ানো।
২) কম্পোজিশনের ক্ষেত্রেও ম্যানারিস্টরা পরিবর্তন এনেছে। কখনো তাতে ভারসাম্যহীনতা লক্ষ্য করা যায়।
৩) ক্ল্যাসিকাল রীতিতে অনুকেরন কিন্তু তাতে নাটকীয়তার আবির্ভাব।
৪) চিত্রে রঙের ব্যবহারে উজ্জ্বল রঙের প্রাধান্য।
৫) চিত্রে আলোর ব্যবহারে উজ্জ্বল আলোর উপস্থিতি। যেমন : এল গ্রেকোর ‘দ্যা বারিয়াল অফ কাউন্ট অরগাজ’ চিত্রটিতে চোখ ধাধাঁনো আলোর ব্যবহার পাওয়া যায়।
উল্লেখযোগ্য কয়েকজন ম্যানারিস্ট শিল্পী:
১. রসো ফিওরেন্টিনো (১৪৯৪-১৫৪০)
২. পন্টোরমো (১৪৯৪-১৫৫৬)
৩. পার্মিগিয়ানিনো (১৫০৩-১৫৪০)
৪. টিন্টোরেট্টো (১৫১৮-১৫৯৪)
৫. এল গ্রেকো (১৫৪১-১৬১৪)
দ্যা বারিয়াল অফ কাউন্ট অরগাজ : (১৫৮৬, তেলরং)
চিত্রটি বিখ্যাত ম্যানারিস্ট শিল্পী এল গ্রেকোর আঁকা। চিত্রটি টলতোর সান্তো তোমে গীর্জার জন্য আঁকা। ছবির বিষয় স্বর্গ হতে স্টিফেন এবং অগাষ্টিন মাটির পৃথিবীতে নেমে কাউন্ট অরগাজের মৃতদেহকে শবাধারে রাখছেন। এই ছবিটি দুটি অংশে বিবক্ত। একটি মাটির পৃথিবী, অপরটি স্বর্গ। শিল্পী নিজস্ব কিছু এখানে দেখিয়েছেন লম্বাটে এবং তরঙ্গায়িত ফিগার, পতপত করে উড়ে যবার মতো কাপড়, শীতল হাইলাইট এবং অদ্ভুত ধরনের ভাসমান মেঘ।
এল গ্রেকো (১৫৪১-১৬১৪):