Wednesday 9 November 2011

সিন্ধু সভ্যতা

সিন্ধু সভ্যতা ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীনতম সভ্যতা । সিন্ধু নদীর তীরে গড়ে উঠেছির বলে এ সভ্যতাকে সিন্ধু সভ্যতা বলা হয়। আনুমানিক সময়কাল খৃঃ পূঃ ৩০০০ হতে খৃঃ পূঃ ১৫০০ অব্দের মধ্যে ।

সিন্ধু সভ্যতার প্রধান দুটি কেন্দ্র ছিল -

১) হরপ্পা এবং

২) মহেঞ্জোদারো

বর্তমানে লাহোর হতে রাভি নদীর শত মাইল ভাটিতে হরপ্পা আর তিনশ মাইল ভাটিতে সিন্ধু নদীর তীরে মহেঞ্জোদারো । যদিও বৈদিক সভ্যতাকেও ভারতবর্ষে সর্ব প্রাচীন সভ্যতা বলে যে ধারনা এতদিন চলে এসেছিল নতুন প্রত্নতাত্বিক আবিষ্কারের ফলে তা সম্পূর্ণ রূপে পরিবর্তিত হয় ।

১৮৫৬ সালে ইরাবতী নদীর কাছে রেল লাইনের কাজের সময় কর্মীরা একটি ইটের পাহাড় কাটতে গিয়ে তারা কিছু পোড়ামাটির সীলমোহর দেখতে পায় পরবর্তীতে বিশিষ্ট নৃ-তাত্ত্বিক স্যার আলেক জান্ডার কানিং হাম এর গুরুত্ব প্রথম উপলব্ধি করেন ।

স্যার জন মার্শালের উদ্যোগেই পরে কাজ শুরু হয় ১৯২০ সালে প্রায় এক বছর একান্ত নিজের উদ্যোগে রাখাল দাস বন্দোপাধ্যায় সেখানে পুনরায় খননের কাজ শুরু করেন । কানিংহাম মার্শাল স্যার মরটিমার দুইরা কে এন দীক্ষিত ননী গোপাল মজুমদার অর্নেষ্ট ম্যাকাই প্রমুখ হরপ্পা মহেঞ্জোদারোতে পাওয়া চিত্রকলাগুলোর গুরুত্ব বেশি । ভারতবর্ষের গোটা জীবনে এ ছবিগুলো ঘুরেফিরে এসেছে বারবার ।

মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পার নগর ব্যবস্থা

সিন্ধু নদ হতে প্রায় চারশ মাইল দক্ষিণে সিন্ধু জেলায় আরো একটি প্রাচীন নগরীর আবিষ্কার হলে এর নাম দেয়া হল মহেঞ্জোদারো যার অর্থ মৃত নগরী । একে মৃত নগরী বলা হলেও খননকর্মের ফলে জানা যায় যে এক সময়ের সমৃদ্ধ নগরী ছিল । এই ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কারের পর পার্শ্ববর্তী গ্রামের নামানুসারে নামকরন করা হয় হরপ্পা ।

মহেঞ্জোদারো হরপ্পা নগরগুলোর বর্ণনা আমরা প্রত্নতাত্তিকদের বিভিন্ন বিবরণে পেয়েছি । মাটির ফুইলার তাঁর বইতে এর মনোরম বর্ণনা দিয়েছেন পরিপাটি এই নগর ব্যবস্থা ছিল সে সময়ের বিচারে আধুনিক । পন্ডিতদের মতে এদুই নগরের সবচেয়ে জাঁকজমক আর অভিজাত সময় ছিল খৃঃ পূঃ ২৯০০ হতে ২০০০ অব্দ পর্যন্ত ।

মহেঞ্জোদারো হরপ্পার সব শহরই রাজার সাধারণ জনগোষ্ঠীর জন্য ঘরবাড়ী তৈরী করতো । তাদের প্রাচীন স্থাপত্য বিশ্লেষণ করে অনেক সাধারণ ঘরবাড়ি রাস্তা নগর পরিকল্পনার সুস্পষ্টই ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গিয়েছে ।

মহেঞ্জোদারো হরপ্পাতে কোন প্রকার বড় রাজ প্রসাদ বা ইমারত ছিল না ।তার পরিবর্তে ছিল বিরাট শস্য রাখার ভান্ডার । অনেক লোকজন বাস করার মত বাড়ি বা বড় বড় প্রাসাদ ও বড় বড় রাস্তা । ছোট ছোট গলি পথ ও ছিল । মূলত নগরটি ছিল পুরোহিত বণিক আর কৃষকদের । সিন্ধু সভ্যতাতেই দেখা গিয়েছিল প্রথমে রোদে শুকানো এবং পোড়া ইটের ব্যবহার ।

সমতল ছাদ বিশিষ্ট একতলা বাড়ি অনেকটা দাবার মত । রাস্তা পয়ঃ প্রণালী পাড় বাধানো পুকুর ছাদ থেকে জল নিস্কাসনের জন্য পোড়ামাটির নল । মহেঞ্জোদারোর পুকুরের আয়তন ছিল ৪০ ফুট লম্বা ও ২৩ ফুট চওড়া , দূর্গের বাইরেও ছিল পরিকল্পিত শহর । বাড়ি গুলো সবই ছিল দোতলা তিনতলা পাশে চওড়া রাস্তা মাঝে আড়াআড়ি সরু রাস্তা স্নানাগার কুপ ও শৌচাগার পানি সরবরাহ ও পানি নিস্কাশনের ব্যবস্থা । বাধানো ও প্রশস্ত রাস্তার দুপাশে জনগণের অভ্যন্তরে উপরে উঠার সিড়ি আরো ভিতরে শয়ন কক্ষ রান্নাঘর

পাকা নর্দমা ইত্যাদি দেখে ধারনা করা যায় যে , বর্তমান নাগরিক জীবনের সকল উপকরনই সেখানে ‍বিদ্যমান ছিল । এখানে বিশাল আকার স্নানাগারের অস্তিত্ব আবিষ্কৃত হয়েছে । যা ছিল উত্তর দক্ষিণে ৩৯’ ফুট এবং পূর্বে পশ্চিমে ২৩ ফুট প্রসস্থ । এর গভীরতা ছিল ৮ ফুট । এতে নামবার জন্য সিড়ি ব্যবহার করা হত । এসময় গাড়ীর চাকা ও কুমোরের চাকা প্র্রবর্তিত হয় । ঋগ্বেদে রথের বর্ণনা পাই আমরা কিন্তু মহাভারত বর্ণিত রথ চক্রের আবিষ্কার হয়েছিল । প্রাক আর্য যুগে সিন্ধু সভ্যতায় পাথরের দানা ছিদ্র করে তারা মালা তৈরী করত । তুলা হতে সুতা বের করে উৎপাদন করত কাপড় এই যুগে ।

ধর্ম ‍:

হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোর সীল মোহর গুলোতে উৎকীর্ণ লিপি পাঠোদ্ধার না হওয়াতে এই বিশাল সভ্যতাটির অনেক কিছুর মতই ধর্মের বিষয়টি ও অনেকটা স্পষ্ট হয়ে রয়েছে । বিভিন্ন ধ্বংসাবশেষ হতে পাওয়া মাতৃমূর্তি এবং লিঙ্গ জাতীয় প্রতীকই তাদের ধর্ম পোড়ামাটির প্রধান ইঙ্গিত বাহক । হরপ্পা মহেঞ্জোদারোতে পোড়ামাটির অনেক মাতৃত্ব সূচক অঙ্গ প্রত্যঙ্গ গুলো স্পষ্ট করে তুলে ধরা হয়েছে । এসব হতে মনে করা হয় ভারতের প্রচীনতম ধর্মব্যবস্থায় মাতৃকা পূজার প্রাধান্য ছিল । সৃষ্টির মূলে পুরুষ ও নারীর সঙ্গবদ্ধতার প্রতীক হিসেবে এসব আচরনকে চিহ্নিত করা যায় । সব সভ্যতাতেই দেখা গেছে মানুষের শিল্প চিন্তা তার ধর্মকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে ।কখনও একে কেন্দ্র করে শিল্পের বিকাশ হয়েছে আবার কখনও এর বিরুদ্ধে গিয়ে ধর্মের গোঁড়ামির বিপক্ষে ।

সিন্ধু সভ্যতায় প্রাপ্ত শিল্প নিদর্শনাদির মধ্যে রয়েছে :

১। সীলমোহর

২। ভাস্কর্য এবং

৩। মৃৎপাত্র ( হাতে আঁকা চিত্র )

সীলমোহর :

সিন্ধু সভ্যতায় প্রাপ্ত সবচেয়ে উল্লেকযোগ্য ও আকর্ষনীয় দিকগুলো হচ্ছে সীলমোহর । হাজার হাজার সীলমোহর আবিষ্কৃত হয়েছে । এগুলো মাটি হাতির দাঁত দিয়ে তৈরী হত । এতে ছবি খোদাই করা থাকতো ও পাশে লেখা থাকতো । মাটির তৈরী সীলমোহরে নকশা আকার পর ক্ষার জাতীয় জিনিস দিয়ে একটা আস্তরন দেয়া হত । এর পর আগুনে পোড়ানো হত । ফলে পোড়ানোর পর এগুলো বেশ সাদা ও চকচকে হয়ে উঠত । এগুলোর ‍আকৃতি ৩/৪ পয়েন্ট ইঞ্চি হতে ১ ১/২ পয়েন্ট ইঞ্চির মধ্যে । এগুলোর পেছনের দিকে ছিদ্র ছিল , যার মধ্যে সুতা ঢোকানো যেত । এগুলো গহনা হিসেবে ব্যবহার করা হত বলে মনে করা হয় । সিন্ধু সভ্যতার লিপির পাঠ্য করা সম্ভব হয়নি বলে সীলমোহর উৎকৃষ্ট প্রাণীর চিত্র ও এর সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি ।

এসব সীলমোহরে বিচিত্র সব জীবজন্তু ও ছবি খোদাই করা ছিল । প্রাণীগুলো স্বাভাবিক বা কাল্পনিক রূপে খোদিত হত । এসব প্রাণীর মধ্যে ছিল ষাঢ় , বাঘ , হাতি , এক শিংওয়ালা গন্ডার , খরগোশ , হরিণ , মিত্রি জীব এবং অদ্ভুত শিংওয়ালা ষাঢ় । কিছু কিছু সীলমোহরে জ্যামিতিক নকশা ও প্রতীক উৎকৃষ্ট ছিল । এগুলোর মধ্যে বৃত্ত , ক্রস চিহ্ন , বিন্দু আঁকা ছিল ।

মহেঞ্জোদারোয় প্রাপ্ত সীলমোহরগুলো হচ্ছে ভারতীয় উপমহাদেশের সর্ব প্রথম শিল্পকর্ম , এসব সীলমোহরে খোদাইকৃত বিষয়বস্তু দেখলে জীবজন্তুর প্রতি গভীর অনুরাগ সৃষ্টি হয় । পর্যশালী শিল্পকর্ম হচ্ছে মানুষের মূর্তিবিশিষ্ট সীলমোহর এ সীলমোহর হতে এ উপমহাদেশের এক প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী যোগ সাধনার ধারনা পাওয়া যায় ।

এ সীলমোহরটিতে খোদাই করা ছবির বিষয়বস্তু হচ্ছে এতে একটি নীচু সিংহাসনে যোগামনে একটি ফিগার উপবিষ্ট । তার হাত দুটিতে শাখা পরিহিত এবং মাথায় মুকুট পরিহিত যা শিবের ত্রিমূলের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ । মাথার মুকুটটি দেখে এটিকে কোন পবিত্র মূর্তি বলেই মনে করা হয় । এছাড়াও সীলমোহরটিতে অন্যান্য প্রাণীর ছবিও খোদাই করা আছে ।

ভাস্কর্য :

সিন্ধু সভ্যতায় প্রাপ্ত ভাস্কর্য সমূহের মধ্যে রয়েছে ছোট ছোট বিভিন্ন ধরনের পুতুল এবং মূর্তি । উল্লেখযোগ্য হচ্ছে :

১ । নৃত্যরত রমনী

২ । লাল চুনাপাথরের পুরুষ মূর্তি

৩ । একজন পুরোহিত রাজা বা দেবতা

৪ । অসম্পূর্ণ নৃত্যরত মূর্তি এবং

৫ । পোড়ামাটির পুতুল

১ । নৃত্যরত রমনী :

মহেঞ্জোদারোয় প্রাপ্ত ক্ষুদ্র এ মূর্তিটি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষন করে । এর উচ্চতা ১৪ সেঃ মিঃ । অনেকে একে দেবদাসী মূর্তি বা প্রতিমা মূর্তিও বলেন । নৃত্যরত তরুনী এই মূর্তিটি বাস্তববাদী শিল্পকলার একটি উদাহারন । এটি সম্পূর্ন নগ্নমূর্তি । দন্ডায়মান এই মূর্তিটির গলায় রয়েছে হার ও দুই হাত ভরা বালা বা চুড়ি । তার ডান হাতটির পাশের নিতম্ব কল্পনার জগতে নিয়ে যায় ।এতে এক প্রকার আদিমতা আছে ।

২ । লাল চুনাপাথরের পুরুষ মূর্তি :

এটি হরপ্পাতে পাওয়া গেছে । চুনাপাথরে তৈরী এই পুরুষ টর্সো মূর্তিটি বাস্তবধর্মী । মাংসপেশীর গঠনশৈলী অত্যন্ত নিখুত । যদিও এর বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গে সামঞ্জস্য পাওয়া যায়নি । এই মূর্তিটির গতিময়তা এসেছে ভেতর হতে বাহির হতে নয় তাই এটিকে ভারতীয় মূর্তি বলে সনাক্ত করা হয়েছে ।এত গ্রিক হেলেনিষ্টিক বাস্তবদের তুলনায় বরং পরবর্ত কালের ভারতীয় যোগিক , প্রাণশক্তির অস্তিত্বই বেশী বহন করে ।

৩ । একজন পুরোহিত রাজা বা দেবতা :

হরপ্পায় প্রাপ্ত মূর্তিগুলোর মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মূর্তি হচ্ছে একজন পুরোহিত রাজা বা দেবতা । এর উচ্চতা ১৭.৫ সেঃ মিঃ এবং আনুািনিক এর সময়কাল ২০০০ হতে ১৭৫০ খৃঃ পূঃ । মূর্তিটির মুখে গোঁফ নেই কিন্তু দাঁড়ি আছে ও মাথার চুল পেছনে ঝুটি বাঁধা । এর ডানহাতের উপরের অংশে বাসা পরিহিত । চোখের ভেতর শংখ দিয়ে মনি তৈরী করা হয়েছে । মূর্তিটির ঠেঁট বেশ মোটা । তাতে মনে হয় এটি একটি দামের । তার পোশাকে ত্রিকোনাকার নকশা কাটা ।

৪ । অসম্পূর্ণ নৃত্যরত মূর্তি :

হরপ্পার উল্লেখযোগ্য নিদর্শনাদির মধ্যে অআছে অসম্পূর্ণ নৃত্যরত মূর্তি । এটি একটি পুরুষের দেহের উর্ধাংশ । ছাইরঙ্গের পাথরের নির্মিত এই মূর্তিটির উচ্চতা মাত্র ১০ সেঃ মিঃ । মোচড়ানো অবস্থায় নির্মিত এ মূর্তিটিকে শিব নটরাজের সাথে তুলনা করা হয় ।এই মূর্তিটির পা ভগ্ন অবস্থায় পাওয়া গেছে । এর ঘাড় ও কাঁধের ছিদ্র দেখে মনে হয় যে এর মাথা আলাদাভাবে নির্মাণ করে এতে লাগানো হত ।

৫ । পোড়ামাটির পুতুল :

মহেঞ্জোদারোয় পাওয়া গেছে ছোট ছোট বিভিন্ন ধরনের পুতুল । এগুলো সবই পোড়ামাটির কোনটি মানুষের আবার কোনটি প্রাণীর । এই সমস্ত পুতুলের মধ্যে আছে অনেক মাতৃমূর্তি । স্থল রূপের মাতৃমূর্তির সঙ্গে লোকশিল্পের সম্বন্ধ স্পষ্ট ।

মৃৎপাত্র :

বিভিন্ন ধরনের মৃতপাত্রের সন্ধান পাওয়া গেছে সিন্ধু সভ্যতায় । আর চিত্রকলা বলতে মৃৎপাত্রে অঙ্কিত চিত্রকেই বলা হয় । গৃহের কাজে ব্যবহার ছাড়াও মৃৎপাত্রগুলো সব কাজেই ব্যবহৃত হত ।

সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংসের কারন সঠিকভাবে না জানার কারণে ধারনা করা হয় যে সেগুলো বিভিন্ন প্রাকৃতিক কারনে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় । পরবর্তীতে দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে আর্য জাতীর এ উপমহাদেশে আগমন হয় খৃঃ পূঃ ১৫০০ সালে ক্রমে ক্রমে তারা এ উপমহাদেশের বিশাল জনসমূদ্রের সাথে একত্র হয়ে যায় ।

No comments:

Post a Comment