Tuesday 29 December 2009

পটচিত্র

পট্ট শব্দ হতে পট শব্দের উত্‍পত্তি৷ পট বা কাপড়ের উপর অঙ্কিত চিত্রের স্থলে কাগজ আবিষ্কারের পর তাতে ছবি অাঁকার প্রচলন হলেও পট শব্দ চিত্র অর্থে অভিধানে স্থান পেয়েছে৷ লোকশিল্পের একটা প্রাচীন মাধ্যম 'পট'৷ বৈদিক ও বৌদ্ধ গ্রন্থাবলীতে চিত্রাঙ্কনের উলেস্নখ দেখা যায়৷ ক্রীষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে পানিনির ভাষ্যকার পতঞ্জলী কর্তৃক উলেস্নখ এ চিত্রকর্মেও প্রাচীনত্বেও প্রমাণ৷ বুদ্ধদেবের জীবনী ও পূর্বজন্ম সংক্রানত্ম জাতকের গল্প সম্বলিত পট মস্করী ভিৰুরা প্রদর্শন করতেন৷ সপ্তম শতাব্দীর গোড়ার দিকে রচিত হর্যচরিত ও অষ্টম শতকের মুদ্রারাৰসে পটুয়াদেও উলেস্নখ আছে৷ দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতাব্দীতে পটুয়ারা সক্রিয় ছিলেন৷ পনেরো শতকের কবিরা সংস্কৃত সাহিত্য হতে রাধা-কৃষ্ণ, রাম-সীতা প্রমুখের কাহিনী বাংলা ভাষায় পরিবেশন করেন৷ এ সব কাহিনী অবলম্বনে এ সময় কৃষ্ণলীলা, রামলীলা পটের প্রচলন হয় বলে অনুমিত৷ ষোড়শ শতাব্দীতে চৈতন্যদেবের বাণী প্রচাওে পট অঙ্কিত হয়৷ ঐ শতকের কবি মুকুন্দরামের কাব্যে পটের উলেস্নখ আছে৷
গাজীর পটের প্রবর্তনের কাল পনেরো শতক বলে অনুমান করা হয়৷ এ সময় পীরবাদেও প্রভাব দেখা যায়৷ ইসমাইল গাজী সুলতান বরবক শাহের ( ১৪৫৯ - ৭৪ ) ধর্মপ্রাণ কর্মচারী ও বীর যোদ্ধা ছিলেন৷ তিনি সুলতানের নির্দেশে উড়িষ্যা ও কামরূপ জয় করেন৷ ষোড়শ শতাব্দির শেষভাগে শেখ ফয়জুলস্নাহ তাঁর বীরত্ব ও আধ্যাত্মিকতা উপজীব্য কওে গাজী বিজয় রচনা করেন৷ কিংবদনত্মীর এ গাজী কেলে শাহ একদিল গাজী নামেও পরিচিত৷ সুন্দরবনের বাঘের নিয়নত্মা হিসাবে বাওয়ালী বা কাঠুরিয়া এবং মাওয়ালী বা মধু সংগ্রহকারীদেও বাঘবন্দী মন্ত্রে তাঁর নাম উচ্চারিত হয়৷
এক হাজার বছর আগে হতে ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যনত্ম পটুয়ারা পট প্রদর্শন করতেন৷ বিগত শতাব্দী এমন কি বর্তমান শতকের গোড়ার দিকেও ঢাকা, নোয়াখালী, ময়মনসিংহ, রাজশাহী জবেং পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটি জেলাতে পটুয়া সঙ্গীতসহ পট চিত্র প্রদর্শণ করতেন বলে অমিয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় সূত্রে জানা যায়৷
পট অঙ্কিত হতো কাপড়ের উপর৷ এরপর কাপড়ের উপর কাগজ লাগিয়ে মানচিত্রের মতো তা অাঁকা হতো৷ কাপড়ের উপর কখনো কেবল কাদামাটি কখনো গোবর মিশ্রিত প্রলেপ দিয়ে, তার উপর তেঁতুল বিচির আঠা বুলিয়ে চিত্রের জন্য মসৃন ও দীর্ঘস্থায়ী জমিন তৈরি করা হতো৷ ইটের গুঁড়ার সঙ্গে তেঁতুল বিচির আঠা মিশিয়েও জমিন তৈরী করা হতো৷ পট অাঁকা হয়ে গেলে পট শিল্পী নিজে সঙ্গীত সঙ্গতে তা প্রদর্শন করেন৷ বিক্রমপুর অঞ্চলে পট প্রদর্শনকে 'পট নাচান' বলা হয়৷ পটুয়াদের বহুমুখী প্রতিভার জন্য বলা হয় _ 'একাধারে ইহারা ভক্ত সাধক কবি গায়ক ও চিত্রশিল্পী অর্থাত্‍ একদেশদর্শী শিল্পী নন'৷ অবশ্য পটশিল্প ও তার প্রদর্শক কোনো কোনো ৰেত্রে ভিন্নও হন৷
বিষয়বস্তু এবং আকৃতির উপর ভিত্তি করে পটের শ্রেণীবিন্যাস করা হয়৷ ছোট আকৃতির একক চিত্র বিশিষ্ট পটের নাম 'চৌকা পট' এবং বহু চিত্র সম্বলিত পট 'দীর্ঘ পট' বা জড়ানো পট (ংপত্‍ড়ষষ) নামে পরিচিত৷ চৌকা পটের আয়তন দৈর্ঘ্যে এক ফুট বা কিছু অধিক, প্রস্থ ৬"_৮"৷ অজিতকুমার মুখোপাধ্যায়ের মতে, জড়ানো পট ১৫ হতে ৩০ ফুট লম্বা, ২ হতে ৩ ফুট চওড়া৷ যাদু পটুয়াদেও জড়ানো পট অপেৰাকৃত ছোট এবং পশ্চিম বঙ্গের সাঁওতাল এবং পূর্ববঙ্গেও বেদেদের (ুইবফরুধং ড়ভ ঊধংঃবত্‍হ ইবহমধষরচ্) কাছে তা প্রদর্শিত হয়৷
চৌকা পটের আওতায় আসে দু'রকমের পট ঃ চৰুদান পট ও কালিঘাটের পট৷ মৃত ব্যক্তির কল্পিত ছবি এঁকে পটুয়া তাতে চোখের তারা অবশিষ্ট রেখে প্রয়াত ব্যক্তির আত্মীয়-স্বজনের কাছে এসে চিত্রকর বলে, চোখের মনির অভাবে মৃত ব্যক্তি স্বর্গে যাবার পথ খুঁজে পাচ্ছে না৷ উপযুক্ত দর্শনী নিয়ে পটুয়া তার স্বর্গের দ্বার উন্মোচন করে৷ গুরম্নসদয় সংগ্রহশালায় কিছু চৰুদান পট রৰিত আছে৷ স্টেলা ক্রামরিশ এই পটুয়াদের বলেন 'যাদু পটুয়া'৷
অষ্টাদশ শতাব্দী হতে বিংশ শতাব্দির প্রথম ভাগ পর্যনত্ম কলকাতার কালিঘাট মন্দিরের দূরের অবস্থিত পটুয়া পাড়ায় কালিঘাটের পট নামে খ্যাত কাগজের উপর তুলির টানে অঙ্কিত চৌকা পটের প্রসার ঘটে৷ এ পটুয়ারা প্রথমে সূত্রধর পওে প্রতিমা শিল্পী এবং তার পওে পটশিল্পীতে রূপানত্মরিত হন৷ এসব ছবি সসত্মায় বিক্রয় হতো৷ দীনেশচন্দ্র সেন একখানা পটের দাম দু'পয়সা বলে উলেস্নখ করেন৷ এজন্য এগুলিকে "নধুধত্‍ ঢ়ধরহঃরহমং" বলা হতো৷ ুঞযব ঢ়ধরহঃরহমং ধহফ নত্‍ঁংয ফত্‍ধরিহমং ধত্‍ব সড়হঁসবহঃধষ রহ ঃযবরত্‍ ত্‍বঢ়ত্‍বংবহঃধঃরড়হ ড়হ ড়ঃযবত্‍রিংব সড়ংঃষু নষধহশ ঢ়ধমব.চ্ বলেন স্টেলা ক্রামরিশ৷
কালিঘাটের পট আজ বিলুপ্ত৷ পটুয়ারা আবার মূর্তি পুতুল গড়ার পেশা গ্রহণ করেছেন৷ আনুমানিক ষাট বছর বয়স্ক শীশচন্দ চিত্রকর (পাল) একমাত্র ব্যতিক্রম৷ এ লেখকের সঙ্গে ১৯৮৭ সালের ২৭শে জুন এক সাৰাত্‍কারে তিনি বলেন, সরকারের ইচ্ছা একটি প্রশিৰণ কেন্দ্র খুলে তিনি আবার পটুয়া গোষ্ঠী গড়ে তুলুন৷ কিন্তু তাতে প্রশিৰণ প্রাপ্তদের পেটের ভাত জুটবে কিনা সে বিষয়ে তিনি সন্ধিহান৷
বিষয়ভিত্তিক শ্যেণীবিন্যাসে আছে চন্ডীপট, শক্তিপট, দশ অবতার পট, রামলীলা পট, কৃষ্ণলীলা পট, মনসাপট, যমপট ও গাজীর পট৷ চৰুদান পট আর যাদু পটও এ শ্যেণীর আওতাভুক্ত৷ নাম হতে পটগুলির বিষয়বস্তু অনুমান করা হয়৷ কাহিনী চিত্র সম্বলিত জড়ানো পটের শেষের দিকে কয়েকটি প্যানেলে পরকালে পাপাচারীদেও যমের দেয়া শাসত্মির কিছু চিত্র তুলে ধরা হয়৷ তাই এর নামকরণ যমপট৷ তাতে নৈতিক অধঃপতন রোধের চেষ্টা দেখা যায়৷ পঞ্চকল্যাণী পট নামক এক পটের উলেস্নখ করেন আশুতোষ ভট্টাচার্য৷ তাতে একক কোনো দেবদেবীর লীলা অঙ্কিত না হয়ে বিভিন্ন দেবদেবীর এক একটি লীলা অঙ্কিত৷ এ পটের জমিন অবশ্য মৃত্‍পাত্র এবং তার শিল্পী কুম্ভকার৷ উলেস্নখ্য যে; পট অনেক সময় বিগ্রহের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হয়৷ ব্যবসায়ীরা এককালে তাঁদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পট ঝুলাতো বলে জানা যায়৷
"জড়ানো পটের উত্‍স নিশ্চিতভাবেই অজানত্মার দেয়ালচিত্র৷ ঐ চিত্রের নিকটতম প্রতিবেশী অন্ধ্র স্কুল"৷ বলেছেন বোরহানউদ্দিন খান ঝাহাঙ্গীর৷ কল্যাণকুমার গঙ্গোপাধ্যায়ের মতে, অষ্টাদশ শতাব্দীর রাজধানী বিশেষ করে জয়পুর ধারা এবং ঐ সময়কার মোগল চিত্রকলার কিছু প্রভাব এই শিল্পে দেখা যায়৷ বিনয় ঘোষ পটের বলিষ্ঠ রেখায় মুসলিম ক্যালিগ্রাফী বা হসত্মলিপির প্রভাবের কথা উলেস্নখ করেন৷ অমিয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, "উলেস্নখিত শিল্পধারার অনুরূপ কোনো দরবারী অঙ্কন রীতি বঙ্গদেশে বিকশিত না হলেও রঙ্গিন পট, পুঁথি ও পুঁথির পটচিত্রে অনত্মত পাল রাজাদেও কাল হতে এখানে একটা নিজস্ব শিল্পরীতে গড়ে ওঠে৷ উভয়েই বাঙালি মনীষার নিজস্ব সৃষ্টি, নিকট বা দূরের রীতি দ্বারা প্রভাবিত নয়"৷ এ পদ্ধতিটিট দীর্ঘস্থায়ী হতে পারেনি৷
চিত্রশৈলী সম্পর্কে ওয়াকিল আহমদের ধারণা বিরূপ৷ "পটচিত্রের সূ্থল রেখার কায়া আছে সূৰ রঙ্গেও মায়া নেই"৷ এ মতের বৈপরীত্ব দেখা যায় কল্যাণকুমার গঙ্গোপাধ্যায়ের উক্তিতে _ ুঞযব ঢ়ধঃধং ধত্‍ব ভষধঃ রহ ঃত্‍বধঃসবহঃ নঁঃ ঃযবরত্‍ ষধহমঁধমব রং নবংঃ ঁহফবত্‍ংঃড়ড়ফ রহ ঃযব ারমড়ত্‍ড়ঁং ধহফ ংবিবঢ়রহম ড়ঁঃষরহবং ধহফ রহঃবহংবষু ড়িত্‍স পড়ষড়ত্‍.চ্৷
বিশেষ কওে কালিঘাটের পট সম্পর্কে অজিত মুখোপাধ্যায়ের সাধুবাদেও ভাষা হলো ুঃযব ষরহবং ধত্‍ব ফরংঃরহপঃষু নড়ষফ ংরিভঃ ধহফ ধঃঃত্‍ধপঃরাবচ্. সংযোজিত কলিঘাটের পটটি তার প্রমাণ৷ গ্রামবাংলার সহজ সরল জীবনের সার্থক প্রতিফলন ঘটে এ লোকশিল্পীদের সাধারণ তুলির টানে৷ দ্বিমাত্রিক ও সমতলভিত্তিক পটচিত্রে গতি আনয়ন করে তার বলিষ্ঠ রেখা আর রঙের উষ্ণতা৷ স্বাভাবিক আলোকে প্রদর্শিত হয় বলে পটের রং সাধারণত উজ্জ্বল৷ নাটকীয়ভাবে সঙ্গীত সঙ্গতে তার প্রদর্শন গুটান চিত্রে যেটুকু অপূর্ণতা থাকে, তা মোচন করে৷ বিষয় নির্বাচন, দৃশ্য নির্মাণ ও উপস্থাপনার কোনো ধরা বাঁধা নিয়ম নেই৷ স্বাভাবিক দৰতায় তাঁরা চিত্রাঙ্কন করে থাকেন৷
ড.সুকুমার সেন তাঁর "ইসলামী বাংলা সাহিত্য" গ্রন্থে উলেস্নখ করেন যে, উভয় বঙ্গের মধ্যে কেবল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশুতোষ মিউজিয়ামে একটি মাত্র গাজীর পট আছে৷ সম্প্রতি অবশ্য সে সংগ্রহশালা এবং গুরম্নসদয় দত্ত মিউজিয়ামেও একাধিক গাজীর পট সংগৃহীত হয়েছে৷
ফোর্ড ফাউন্ডেশন ও কারিকার যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত লোক কারম্নশিল্প জরিপ প্রকল্পের আওতায় গ্রাম পরিক্রমায় মোহনগঞ্জ হতে নরসিংদীর গাজীর পট প্রদর্শণীতে কোনাই মিয়ার খবর পেয়ে তার কাছে সুধীর আচার্য়েও হাতে অাঁকা একটা গাজীর পটের সন্ধান পাওয়া যায়৷ কোনাই মিয়ার সহায়তায় আমরা শিল্পী সুধীরচন্দ্রের সাৰাত্‍ লাভ করি৷ এভাবে সারা জীবনের নীরব সাধক এ পটশিল্পী আবিষ্কৃত হন৷
মুন্সীগঞ্জ জেলায় কাঠপট্টির কালিন্দীপাড়ায় আশ্রমসম গৃহে সুধীর আচার্যের নিবাস৷ ১৩১৯ সালের ৯ই চৈত্র তাঁর জন্মতারিখ৷ তাঁর বিশ বত্‍সর বয়সে পিতা প্রাণকৃষ্ণ আচার্য পরলোক গমন করেন৷ পিতামহ রামসুন্দর আচার্য এবং প্রপিতামহ রামগোপাল আচার্য সবাই ছিলেন পটশিল্পী৷ তাঁর আটাশ বছর বয়স্ক পুত্র শম্ভূনাথ আচার্যও একজন চিত্রকর৷ তিনি নারায়নগঞ্জের একটি বিদ্যালয়ে কমার্মিয়াল আর্টে শিৰা লাভ করেন৷ তাঁর রীতি ঐতিহ্যাশ্রয়ী নয়৷ পরিবারের প্রাচীন ধারাটি অৰুন্ন রাখার জন্য তাঁকে অনুরোধ জানানো হয়েছে৷ তন্তুরায় অধু্যষিত নরসিংদীতে এ পরিবারটি আট পুরম্নষ হতে তাঁতের শাড়ির পাড়ের নকশা অাঁকেন৷ সুধীর আচার্য জ্যোতিষ শাস্ত্রেও পারদর্শী৷ সব সম্প্রদায়ের লোক তাঁর আসত্মানায় আসেন গণনা ও ঝাড়ফুঁকের জন্য৷
পট অঙ্কনে তাঁর রীতি হলো, প্রথমে ইটের গুঁড়া কাপড় দিয়ে চেলে নেয়া৷ পাতলা কাপড়ে তা ছেঁকে তেঁতুল বিচির কষ বা আঠা দিয়ে গুলে একখানা গামছার উপরে তিনবার ও নীচে দু'বার তা লাগাতে হয়৷ পাউডার রঙ দিয়ে সাধারণ তুলির সাহায্যে ক্যানভাসের উপর সুধীর আচার্য পট আাঁকেন৷ মাটির উপর গামছা বিছিয়ে পট অঙ্কন করা হয়৷
লেখকের ব্যক্তিগত সংগ্রহে তাঁর অঙ্কিত যে পটটি আছে তার পরিমাপ ৪'-১০'*২',কয়েকটি প্যানেলে ভাগ কওে তার উপর লাল, নীল, হলুদ, সবুজ, গোলাপী, বাদামী, সাদা ও কালো রঙ লাগিয়ে ছবি অাঁকা হয়েছে৷ মাঝখানে আছে ৪'-১০*১'-৪" মাপের একটি বড় ছবি৷ তার উপরে ও নিচে তিন সারি ছবি৷ প্রতি সারিতে তিনটি কওে চিত্র অাঁকা৷ একেবারে নিচের সারিতে মাঝখানে দু'টি পিলার বা খামের ওপর তিনটি করে চিত্র অাঁকা আর্চ বা তোরণের নিচে তিনটি ছবি৷ এটিকে একটি ছবি ধরলে চিত্রের সংখ্যা দাঁড়ায় তেইশ, তিনটি ধরলে পঁচিশ৷ মাঝের বড় ছবিতে বাঘের পিঠে সওয়ার হয়ে আছেন গাজী পীর৷ তাঁর এক হাতে চামর, অপর হাতের মুষ্টি ঘিওে জ্যোতি৷
গাইন নামে পরিচিত গাজীর গানের গায়কদেও হাতে এ চামর ও আশা বা আশাদানা থাকে৷ তিনি আসা বা লাঠি মাটিতে পুঁতে তাঁরা হিন্দু মুসলমানদেও বাড়ি বা সমাবেশে মন্ত্রবত্‍ গাজীর গান পাঁচালি উচ্চারণ করেন৷ মানুষের মাথার উপর আসা বুলিয়ে তাদেও মঙ্গল কামনা করেন৷
বড়চিত্রের বাঘের সামনে ও পিছনে দ'জন লোক, একজনের হাতে কালো রঙের ত্রিকোণাকার পতাকা, একজন ধরেছে গাজীর মাথায় ছাতা৷
সুধীর আচার্য ছবিগুলির পরিচয় দিয়েছেন এভাবে উপরের বাম কোণ হতে (১) মকরবাহী গঙ্গা (২) ঘোড়া ও সহিস (৩) পুইস্কার বাবা মা (মাঝে হুক্কা) (৪) হরিণ জবাই, (৫) নাকাড়ায় বাড়ি ও (৬) গাজীর আসা (৭) চৈতার মা চিড়া কুটে, (৮) শিমূল গাছ, (৯) সওদাগরের বাণিজ্য যাত্রা, (১০) আন্দুরা বাঘ, (১১) গাজীর ছাতার দু'পাশে দু'টি টিয়া পাখি, (১২) খান্দুরা বাঘ, (১৩) উপরে উলিস্নখিত মাঝখানের বড় প্যানেল, (১৪) কুমিরের সওয়ার (১৫) লৰীদেবীর সিঁদুরের কৌটা, (১৬) স্বামী চুল ধরে মারে, (১৭) গোয়ালার গাভী নিলো বাঘে, (১৮) খোঁপা মাথায় নারী, (১৯) স্ত্রীলোককে বাঘে আক্রমণ, (২০) বৰিলা উল্টা করে বাঁধা, (২১) চরখায় সূতা কাটা, (২২) দধির ভারসহ গোয়ালা, (২৩) যমদূত, (২৪) যম রাজার মা, (২৫) কালদূত৷
নিচের তিনটি চিত্রের সংযোজন ইঙ্গিত করছে গাজীর পট হয়েও এটি একটি যমপট৷ কোনাই মিয়া অনুরূপ একটি পুরো পট প্রদর্শন করেন৷ প্রাসঙ্গিক পটুয়া সঙ্গীতে যম সম্পর্কিত তাঁর গানের পয়ার নিম্নরূপ _
যমদূত কালদূত ডাইনে আরো বায়৷
মধ্যখানে বইসা আছে যমরাজের মায়৷
যমদূত কালদূত দেইখ্যা লইবেন তারে
দুই হাতে দুই লোহার গদা যমের মতো ফিরে৷
যমরাজের মায় বইছে তামার ডেকচি লইয়া
অতি পাপী মানুষের কলস্না দিছে সে ডেগে ফালাইয়া৷
এই ছিলো কোনাই মিয়ার গানের সমাপ্তি৷ এর শুরম্ন গাজীকে নিয়ে৷
ধুয়া :
গাজীর নাম কেন লইলা নারে দেহের গুমান করে৷
দম দম বলিয়া মন দমে করি হিতি
এই দম ফুরাইয়া গেলে কি লইয়া বসতি৷
গাজীর বাপের নাম শাহ সেকান্দর৷
রওনক শহরে বানছে মদিনা বাড়ীঘর৷
পাতাল জিন্দা করে বিয়া বলিরাজের বেটা৷
সে ঘরেতে জন্ম নিল পীর জিন্দা গাজী৷
এ হলো কিংবদনত্মীর গাজীর বংশ পরিচয়৷ মাঝখানের বড় চিত্রের দু'টি লোকের পরিচয় মিলে কোনাই ব্যাপরীর পয়ারে৷
লোকঐতিহ্যের দশ দিগনত্ম
গাজীর ভাই কালু ছাতা ধরিলো
গামনেতে মানিকপীর নিসান ধরিলো৷
কালু গাজীকে তাঁর অলৌকিক ক্রিয়া প্রদর্শনের জন্য অনুরোধ জানান _
একযুগ বারো বছর রইলাম বনে বনে
কি ফকিরী পাইলা ভাই দেখাও আমারে৷
বারো বছর ধওে একটি শিমুল গাছ মওে আছে৷ সে গাছকে পুনর্জীবিত না করতে পারলে কালু তার সঙ্গ ছাড়বে৷
বিছমিলস্নাহ বলিয়া গাজী গাছে রাখে হাত৷
গাজীর দোয়ায় বাইচ্চা উঠে মরা শিমুল গাছ৷
ডশমুল গাছের অঙ্কন সরল৷ মাঝে কা-, দু'পাশে তিনটি কওে ছয়টি প্রশাখাহীন শাখা, তাদেও মাথায় এক একটি অনত্মর ফুল ও পাতা৷
পটুয়া সঙ্গীতটি চারটি অংশে বিভক্ত _ গাজীর অলৌকিক শক্তি, কিছু হিতোপদেশ, কিছু 'রঙের কথা', পরিশেষে যম৷
হিতোদেশের নমুনা :
রান্ধিয়া বান্ধিয়া অন্ন পুরম্নষের আগে খায়
ভরানা কলসের পানি তিরাসে ফুরায়৷
* * *
দুব দুবাইয়া হাটে নারী চোখ গোরাইয়া চায়৷
অলৰীওে দিয়া ঘরে লৰী লইয়া যায়৷
কিছু রঙ্গরস :
চুলনা বুড়ি চুলের লাগি কান্দে
কচুর পাতা দিয়া তার খোপা বড় করে৷
* * *
আটতে জানে না বুড়ি চিবি গুয়া খায়
ডবয়া সাদীর কথা শুনলে তুর তুরাইয়া যায়৷
পটুয়ারা পট দিয়ে বাড়িতে বাড়িতে পট দেখিয়ে পারিশ্রমিক হিসেবে ধান পায়৷ পটের মালিক একজন মহাজন বেদে৷ গায়ক গরীব বেদে৷ পটের জন্য তিন ভাগের এক ভাগ পায় মহাজন বেদে, গানের জন্য পায় দু'ভাগ৷ দুই যুগ আগে এ ছিলো ব্যবস্থা৷ এ তথ্য পাওয়া যায় সুধীর আচার্যের কাছে৷ এখন ধরতে গেলে পট তৈরী হয়ই না৷ বছরে চার পাঁচটা এখন বিক্রি হয়৷
ধর্ম ও নীতিজ্ঞানভিত্তিক সমাজের অবৰয় পটের বিলুপ্তির অন্যতম কারণ৷ পাশ্চাত্য শিল্পরীতিতে অঙ্কিত চিত্রের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পট টিকে থাকতে পারেনি৷ পট এককালে বিনোদনের মাধ্যমও ছিলো৷ এ ৰেত্রে এসেছে বৈপস্নবিক পরিবর্তন৷ ম্যাজিক ল্যানটার্ন এলো, নির্বাক সবাক চলচ্চিত্র এলো, এলো টেলিভিশন, ভিসিআর, ভি,সি,পি, ভিডিও ক্যামেরা৷ গুঁড়িয়ে দিলো লোকচিত্রের ঐতিহ্যকে৷ সুধীর আচার্য সে বিধ্বসত্ম অতীত এবং তার এক ৰীণ রেশের মধ্যে বন্দী৷ কালিঘাটের পটুয়া শ্রীশচন্দ্র চিত্রকর পেলেন সে দেশের রাষ্ট্রপতির পুরস্কার৷ সুধীরচন্দ্র আচার্যকে আমার জ্ঞাপন করছি আমাদেও প্রতিষ্ঠানের সামান্য স্বীকৃতি৷

Wednesday 2 December 2009

বাংলাদেশের চিত্রিত হাঁড়ি

লোক ও কারম্নশিল্প দৈনন্দিন প্রয়োজনের, উপযোগিতার, আমাদের যাপিত জীবনের-সংস্কৃতির অনুষঙ্গ, সাংস্কৃতিক উপাদান৷ আমাদের দেশের সংস্ক্রতির ক্রমবিকাশের প্রবহমান ধারা স্বনির্ভর গ্রামকেন্দ্রিক কৃষি-কারম্নশিল্প ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থায় লালিত৷ ফলে বাংলাদেশের গ্রামভিত্তিক লোকসমাজের সাধারণ মানুষের অনুভবে, চেতনায় জীবনের অঙ্গ হিসেবে লোক ও কারম্নশিল্প সংস্কৃতির ক্রমবিকাশের ধারায়, নিয়মে সৃষ্টি, বিকশিত, রূপানত্মরের ধারায় অব্যাহত, সক্রিয় রয়েছে৷ মানুষ জীবন যাপনের মতই লোক ও কারম্নশিল্পের ধারাকে সক্রিয় রাখতে সচেষ্ট এবং স্থানিক ও কালিক ব্যবধানে রূপানত্মর প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট ধারাকে অব্যাহত রাখার মাধ্যমে লোক ও কারম্নশিল্পকে প্রতিনিয়ত পুনরম্নজ্জীবনে আত্মনিয়োগ করে চলেছে৷
সাংস্কৃতিক ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ লোক ও কারম্নশিল্প প্রতিনিয়ত আমাদেও প্রতিদিনের জীবনে সহজাত, সক্রিয়৷ ফলে লোক ও কারম্নশিল্প সাধারণ জীবনের অভ্যাসের, রম্নচির, বৈশিষ্ট্যের এবং গোষ্ঠীর পরিচায়ক৷ জাতীয় জীবনে জাতিতাত্তি্বক মর্যাদার, গৌরবের বলে পরিগণিত হয়েছে৷ সংস্কৃতির পরিচয়ের বলে তা মানুষের জীবনাচারণের অনত্মর্ভূক্ত-জীবনঘনিষ্ঠ৷ জীবনের, সংস্কৃতির বহুমাত্রিকতার গুণে, বৈশিষ্ঠ্যে উজ্জ্বল লোক কারম্নশিল্প প্রতিনিয়ত মূল্যায়নের দাবি রাখে৷
মানুষ যেহেতু মনসত্মাত্তি্বক, সেহেতু অনুভব ও চেতনায় প্রয়োজন এবং উপযোগিতার নিরিখে লোক ও কারম্নশিল্পের চিত্রকল্প গড়ে৷ চিত্রকল্প রূপলাভ করে লোক ও কারম্নশিল্পের নানা সৃষ্টিতে৷ একদিকে লোক ও কারম্নশিল্প যেমন প্রত্যাহিক জীবনের প্রয়োজন মেটায় অপরদিকে অনুভব ও চেতনার জগতে সৌন্দর্যের আনন্দ বিকশিত হয়৷ সৌন্দর্যের পরিবেশ, সৌন্দর্য সৃষ্টি হয় লোক ও কারম্নশিল্পে৷ প্রয়োজন ও সৌন্দর্য যুগপত্‍ লোক ও কারম্নশিল্পে ক্রিয়াশীল৷ প্রয়োজনের জন্য লোক ও কারম্নশিল্পের উদ্ভাবন, গড়া হলেও এতে সৌন্দর্য ও সংস্কৃতির আলেখ্য সম্পৃক্ত৷
কারম্নশিল্প সৃষ্টিতে প্রয়োজনের নিরিখে এর গড়ন, আকার অবয়ব নির্দিষ্ট হয়৷ এতে সমন্বয়পূর্ণ, সদৃশরূপ বৈশিষ্ট্য যুক্ত হয়ে লোক ও কারম্নশিল্প ছন্দময়, রূপময়, বর্ণাঢ্য-সৌনন্দর্যগুণের হয়৷ অনুভব ও চেতনার মনোজগত কারম্নশিল্পীর মধ্যে কারম্নশিল্পের সৌন্দর্যের, গড়ণের নিখুত বৈশিষ্ট্যকে সনাক্ত করতে সহায়তা করে, অনুপ্রেরণা দেয়৷ পটভ্থমি, ভিত্তি, প্রেৰিত্‍ থাকে দেশ, প্রকৃতি, পরিবেশ, মানুষ, মানুষের যাপিত জীবনের প্রবহমান ধারা সংস্কৃতি৷ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রেৰিতে কারম্নশিল্পীর বংশ পরম্পরায়ের কৌশল ও দৰতায় সৃষ্টি হয় লোক ও কারম্নশিল্প৷ ফলে লোক ও কারম্নশিল্প নিছক আধুনিক ক্রাফট, হাতের কাজ, হসত্মশিল্প এই পদবাচ্য না হয়ে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বলে বিবেচিত হয়৷ কোন নির্দিষ্ট অঞ্চলের, জনপদেও, নৃগোষ্ঠীর, সম্প্রদায়ের, গোষ্ঠীর, উপজাতির, জাতির সংস্কৃতির পরিচয়বাহী হয়ে ওঠে লোক ও কারম্নশিল্প৷ অঞ্চল ভেদে, নানা অঞ্চলের মানুষের সাংস্কৃতিক, স্বাতন্ত্র্যেও বৈশিষ্ট্যও পরিচয়কে সনাক্ত করায়৷ লোক ও কারম্নশিল্প সাংস্কৃতিক, আঞ্চলিক স্বাতন্ত্র্যের ছাপ, বৈশিষ্ট্য ধারণ করে৷ বৈশিষ্ট্যেও নামে, রূপে ও গড়নে প্রতিষ্ঠা পায়৷
সাধারণ মানুষের জীবনাচারণ সংস্কৃতির অভ্যনত্মরস্থ বস্তু, আধেয়৷ সাধারণ মনুষের জীবনাচারণের ক্রমপুঞ্জিত ধারাবাহিক রূপের পরিচয়বাহী সাধারণ বৈশিষ্ট্য সংস্কৃতি ধারণ করে৷ এবং সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য উপাদান হিসেবে লোক ও কারম্নশিল্পে সাধারণ মানুষের জীবনাচারণের ক্রমপুঞ্জিত রূপকে, সংস্কৃতিকে পরিলৰিত করি৷ সংস্কৃতির ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা রৰিত, বজায় থাকে রম্নপানত্মরের মাধ্যমে পুনরম্নজ্জীবন প্রক্রিয়ায়৷ অনুরূপ প্রক্রিয়ায়, পদ্ধতিতে সাংস্কৃতিক উপাদান-লোক ও কারম্নশিল্প কালিক ব্যবধানে সাধারণ মানুষের রম্নচি, চাহিদার ভিত্তিতে ঐতিহ্যের, উত্তরাধিকারের নিরিখে প্রতিনিয়ত রূপানত্মরের মাধ্যমে পুনরম্নজ্জীবিত হয়ে চলেছে৷ লোক ও কারম্নশিল্পের রূপানত্মরের ধারায় পুনরুজ্জীবন প্রক্রিয়া সূচিত হয় বহুমাত্রিক লৰ্যে৷ লোক ও কারম্নশিল্প হতে সৌন্দর্যের, সুষম ও সুগঠিত, বর্ণাঢ্য, চিত্রগুণ সম্পন্ন লোক ও কারম্নশিল্পে পরিণত হওয়া রূপানত্মরের বহু ধারায় পথ পরিক্রমা মাত্র৷ বস্তুজাতসংস্কৃতি সংশিস্নষ্ট বস্তু, জিনিসের মৌলিক আকার, গড়ণ সময়ের ব্যবধানে সৌন্দর্যের, রূপের রঙের, নকশার, সুষমার লোক ও কারম্নশিল্পে পরিণত হয়ে থাকে৷ ক্রমশঃ লোকশিল্পীর কৌশল ও দৰতায় এতে পস্নাষ্টিক ও গ্রাফিকগুণের সমাহার, সমন্বয় ঘটেছে৷ চিত্র, খোদাই, প্রতিসমগুণসম্পন্ন হয়েছে৷ এভাবে নানা ধারায়, প্রক্রিয়ায় লোক ও কারম্নশিল্পের সৃষ্টির, কৌশলের ও দৰতার ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী কারম্নশিল্পী কালিক ও স্থানিক ব্যবধানে লোকসমাজের সাধারণ মানুষের রম্নচি, চাহিদার প্রেৰিতে রূপানত্মরের মাধ্যমে লোক ও কারম্নশিল্পকে চলমান রাখেন৷ ফলে লোক ও কারম্নশিল্প কখনো উপযোগিতার, কখনো সৌন্দর্যের, আচার-আচরণের৷ এবং প্রতিনিয়ত লোক ও কারম্নশিল্পের সৃষ্টির উদ্দেশ্যের, লৰ্যের বহুমাত্রিকতার গুণ, বৈশিষ্ট্য একে চলমান, অব্যাহত রেখেছে৷
বাংলাদেশের লোক ও কারম্নশিল্প এদেশের প্রকৃতি ও পরিবেশের আদি নৃগোষ্ঠির জীবনযাপনকেন্দ্রিক বস্তুজাত সংস্কৃতির উপর ভিত্তি কওে রূপলাভ করেছে৷ নব্যপ্রসত্মর যুগ থেকে এই অঞ্চলে বসবাসকারী অষ্ট্রিক ভাষাভাষী আদি নৃগোষ্ঠী ও পরবর্তীতে আগত অন্যান্য নৃগোষ্ঠীর মিলিত ও সমন্বিত জীবনযাপনকেন্দ্রিক বাংলাদেশের সংস্কৃতি-বস্তুজাতসংস্কৃতি রূপ পরিগ্রহ করে৷ বিকশিত হয়৷ একটি ভিত্তি তৈরী হয়৷
বস্তুজাত সংস্কৃতির পরিচায়ক এদেশের প্রকৃতি পরিবেশের কাঁচামাল উপকরণ মাটি, বাঁশ-বেত, কাঠ, তন্তুও তৈরি দৈনন্দিন ব্যবহার্য অতিপ্রয়োজনীয় জিনিস৷ যেমন (১) মাটি ঃ হাঁড়ি, পাতিল, কলসী, সানকী, বাটি, সরা, প্রদীপ (২) বাঁশ, বেত, শন, খড় ঃ শনের ঘর, বাঁশের ঘর, মাথাল, ঢুলা, কুলা, চালনি, খালই, ধামা, পলো, চাই (৩) কাঠ ঃ নৌকা, ঢেকী, বাক্স, দরজা, ঘরের খুটি, চৌকাঠ, লাঙ্গল (৪) তন্তু ঃ কাপড়৷ প্রাত্যহিক জীবনের জন্য দৈনন্দিন ব্যবহার্য এসব জিনিস বস্তুজাত, একানত্মই বাংলাদেশের সংস্কৃতির অনুষঙ্গ-বস্তুজাত সংস্কৃতির অনত্মর্ভূক্ত৷ এদেশের বৈশিষ্ট্যের গড়ণ এসব জিনিসে, বস্তুতে স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে৷ কালিক ব্যবধানে উলিস্নখিত বস্তুজাত সাস্কৃতিক উপাদান সমূহ ক্রমান্বয়ে আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় প্রেৰিতে রূপানত্মরের ধারায় সুষমার, সৌন্দর্যেও চিত্র, খোদাই এবং নকশাগুণের লোক ও কারম্নশিল্প পর্যায়ে উপনীত হওয়ার বৈশিষ্ট্য অর্জন করে থাকে৷ বস্তুজাতসংস্কৃতির জিনিস, পণ্য কালভেদে, স্থানভেদে আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে রূপানত্মরিত হয়ে সনাক্ত হয়েছে লোক সমাজের শিল্পকলা-লোক ও কারম্নশিল্প হিসেবে৷ বস্তুজাতসংস্কৃতির সকল আধেয়গুণ, বৈশিষ্ট্যে আরোপিত হয়েছে কারম্নশিল্পীর কৌশল, দৰতা ও সৌন্দর্যবোধ৷ ফলে লোক ও কারম্নশিল্প জাতিতাত্তি্বক-সাংস্কৃতিক৷ সবসবময় সকল কালে, স্থানে এই পরিচয় বহন করে চলেছে৷ লোক ও কারম্নশিল্প সকল সময়ে কোনো সঙস্কৃতির, জাতির, গোত্রের৷
মূলতঃ বাংলাদেশের বস্তুজাত সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য, মৌলিকত্ব, স্বাতন্ত্র্য এদেশের লোক ও কারম্নশিল্প ধারণ করে আছে৷ এদেশের মৃত্‍শিল্প বাংলাদেশের বস্তুজাত সংস্কৃতির নিরিখে, বৈশিষ্ট্যে রূপলাভ, বিকশিত হয়েছে৷ বস্তুজাতসংস্কৃতির অনত্মর্ভূক্ত মৃত্‍শিল্প দৈনন্দিন উপযোগিতা, প্রয়োজন মেটাতে উদ্ভব, সৃষ্টি হয়েছে৷ এদেশের আদি নৃগোষ্ঠীর জীবনধারার উত্তরাধিকারী আজকের বাংলাদেশের বৃহত্তম অংশ গ্রামের লোকজীবনের সাধারণ মানুষ মৃত্‍শিল্পকে চলমান, অব্যাহত রেখেছে৷ এবং আজকের মৃত্‍শিল্প-মৃত্‍পাত্রের ধারা প্রাচীন ধারাই অব্যাহতরূপ৷ এ প্রসঙ্গে ডঃ নীহারঞ্জন রায়ের মনত্মব্য "পোড়ামাটির নানা প্রকারের থালা বাটি, জলপাত্র, রন্ধনপাত্র, দোয়াত, প্রদীপ ইত্যাদি পাহাড়পুরের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে, বজ্রযোগিনীর সনি্নকটস্থ রামপালে, ত্রিপুরায় ময়নামতির ধ্বংসাবশেষের মধ্যে পাওয়া গিয়েছে৷ পাহাড়পুর, মহাস্থান, সাভার ইত্যাদি স্থানে প্রাপ্ত অসংখ্য পোড়ামাটির ফলক ও বিসত্মৃত মৃত্‍শিল্পের সাখ্য বহন করছে"৷ অর্থাত্‍ সাভার, ময়নামতি, বিক্রমপুর, পাহাড়পুর মহাস্থান বা পুন্ড্র অঞ্চলে প্রাপ্ত প্রাচীন লাল এবং ধুসর শ্রেণীর মৃত্‍পাত্রের অব্যাহত ধারা আজকের বাংলাদেশের মৃত্‍পাত্র৷
বস্তুজাত সংস্কৃতির জিনিস-মৃত্‍পাত্র প্রয়োজনের সেই সঙ্গে সৌন্দর্যের, বিশেষ আচার-অনুষ্ঠানের পরিণত হয়েছে৷ সনাক্ত হয়েছে লোক ও কারম্নশিল্পের বলে৷ স্থানিক ও কালিক ব্যবধানে আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রেৰিতে সাধারণ মৃত্‍পাত্র পরিণত হয় সৌন্দর্যেও, চিত্র ও নকশাগুণ সম্পন্ন বর্ণাঢ্য লোক ও কারম্নশিল্পে৷
বাংলাদেশেও মৃত্‍পাত্রের মধ্যে হাঁড়ি সাধারণ গৃহস্থালীর প্রয়োজন হতে সৌন্দর্য়ের, সুষমার, চিত্রগুণ সম্পন্ন চিত্রিত হাঁড়িতে পরিণত হয়েছে৷ অর্থাত্‍ সাধারণত দুই শ্যেণীর হাঁড়ি বাংলাদেশে পাওয়া যায়৷ (১) রান্না বান্নারকাজে, গৃহস্থালী প্রয়োজনে ব্যবহার্য নানা গড়ণ, মাপের, সাধারণ বড়, মাঝারি ও ছোট হাঁড়ি৷ (২) চিত্রিত হাঁড়ি৷ উত্‍সব, পাল-পার্বন-পূজা উপলৰে লোকমেলায় চিত্রিতহাঁড়ি গ্রামে আত্মীয়, কুটুম্বেও বাড়ীতে উপহার হিসেবে পাঠানো হয়৷ সাম্প্রতিককালে এই চিত্রিত হাঁড়ির ব্যবহারে আরো বৈচিত্র এসেছে যেমন এখন বিভিন্ন অনুষ্ঠানের তোরণ নির্মাণে ব্যবহার হয়৷ এবং শহওে নগওে বাড়ীঘরের বৈঠকখানায় চিত্রিত হাঁড়ি সংস্কৃতির পরিচায়ক, অহংকারের, গৌরবের বস্তু হিসেবে স্থান দখল কওে নিচ্ছে৷
অঞ্চলভেদে বাংলাদেশের চিত্রিত হাঁড়ির নাম, গড়ণ, নকশা, চিত্রগুণ এবং সৌন্দর্যে বিভিন্নতা, পার্থক্য লৰণীয়৷ এই চিত্রিত হাঁড়ির নাম কোথাও রঙ্গের হাঁড়ি, কোথাও শখের হাঁড়ি নামে পরিচিত৷ তবে বাংলাদেশে এই চিত্রিত হাঁড়ির অঞ্চলভেদে ভিন্ন ভিন্ন নাম থাকলেও রাজশাহী অঞ্চলের শখের হাঁড়ির নাম বিশেষ জনপ্রিয়৷ এখানে উলেস্নখ্য যে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও অনুুরূপ চিত্রিত হাঁড়ি তৈরী হয় এবং সেখানেও চিত্রিত হাঁড়ির নাম "শখের হাঁড়ি" বলে পরিচিত৷
বাংলাদেশের প্রায় অঞ্চলেই চিত্রিত হাঁড়ি পাওয়া যায়৷ এর মধ্যে উলেস্নখযোগ্য অঞ্চলগুলো হচ্ছে, রাজশাহীর সিন্দুরকুসুম্বী, বায়া, হরগ্রাম, বসনত্মপুর, চাপাই নবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ থানার বারোঘরিয়া গ্রাম, ঝিনাইগতি থানা, ঢাকার নয়ারহাট, কুমিলস্না, গোয়ালন্দ, রাজবাড়ী, ফরিদপুরের কোয়েলজুড়ি ও হাসরা, টাঙ্গাইলের কালিহাতি, জামালপুরের বজরাপুর, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডু থানার ইদিলপুর, ময়মনসিংহের বালাসুর বিশেষ উলেস্নখযোগ্য৷
অঞ্চলভেদে বাংলাদেশের চিত্রিত হাঁড়ির নাম, গড়ণ, নকশা, মোটিফ, চিত্রগুণ ও সৌন্দর্য সৃষ্টিতে বিভিন্নতা, পার্থক্য লৰণীয়৷ হাঁড়ির গড়নে অঞ্চলভেদে বৈচিত্র উলেস্নখ করার মতো, যেমন কোনো অঞ্চলে চিত্রিত হাঁড়িতে ঢাকনা আছে কোথাও ঢাকনা নেই, আবার কোনো অঞ্চলে চিত্রিত হাঁড়িতে হাতল রয়েছে৷ চিত্রে রং ও মোটিফের ব্যবহার রীতির আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য বিশেষ উলেস্নখযোগ্য৷
যেমন রাজশাহীর পবা থানার বসনত্মপুরের শখের হাঁড়িতে ব্যবহৃত মোটিফ, হাতী, ঘোড়া, পাখি, মাছ, রাজহাঁস, পাতিহাঁস, বিভিন্ন ধরনের ফুল, নকশী লতাপাতা, শাপলাফুল, পঁ্যাচা, কবুতর, চড়ুই পাখি ইত্যাদি৷ গোয়ালন্দেও শখের হাঁড়ির মোটিফ ইলিশ মাছ, শাপলা ফুল, পান লতা৷ রাজবাড়ীর শখের হাঁড়ির মোটিফ নকশী লতাপাতা ফুল৷
ঊাংলাদেশের লোক ও কারম্নশিল্পের এক অমূল্য সম্পদ চিত্রিত হাঁড়ি ধারণ করে আছে আবহমান বাংলার লোক সমাজের সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবন, ধর্ম-বিশ্বাস, লৌকিক আচার-আচরণ এবং উত্‍সব৷ আবহমান বাংলাদেশের সাধারণ গ্রামীণ মানুষ হলো এদেশের আদি নৃগোষ্ঠির সঙ্গে অন্যান্য অঞ্চল হতে পরবর্তীতে বিভিন্ন পর্যায়ে আগত নৃগোষ্ঠীসমূহের সম্মিলনে সমন্বিত জীবনযাপনের প্রবহমান এবং ক্রমপুঞ্জিত ধারায় কালিক ব্যবধানে সৃষ্ট রূপানত্মরিত রূপ৷ ফলে লোকজীবনের সৃষ্টি লোক ও কারম্নশিল্প জাতিতাত্তি্বক-সাংস্কৃতিক৷ এর বিশেস্নষণ ও মূল্যায়ন সংস্কৃতির বহুমাত্রিকতায়-জাতিতাত্তি্বক নিরিখে হওয়া বাঞ্চনীয়৷
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের লোক ও কারম্নশিল্পের অনত্মর্ভূক্ত চিত্রিত হাঁড়ির গবেষণা, বিশেস্নষণ, মূল্যায়ন জাতিতাত্তি্বক নিরিখে হওয়া অধিকতর যুক্তিযুক্ত৷ এ প্রসঙ্গে সাংস্কৃতিক ন্রতত্ত্ববিদ হ্যাজেল বার্জারের উক্তি বিশেষ প্রণিধানযোগ্য "ঙহব পধহ হবাবত্‍ সধশব ধ ফবঃধরষবফ ংঃঁফু ড়ভ ধ ড়িত্‍শ ড়ভ ধত্‍ঃ রিঃযড়ঁঃ ফবঃবত্‍সরহরহম রঃং ঢ়ষধপব রহ ঃযব ঃড়ঃধষ ংঃত্‍ঁপঃঁত্‍ব ড়ভ ঃযব পঁষঃঁত্‍ব ধং বিষষ ধং রহ যরংঃড়ত্‍রপধষ ংঃুষব ংবয়ঁবহপবচ্.
লোকশিল্পের জাতিতাত্তি্বক বিশেস্নষণ ও মূল্যায়নে হ্যাজেল বার্জারের গবেষণাধারা ও পদ্ধতি অনুসরণ কওে এর প্রয়োগের মাধ্যমে এ সম্পর্কিত বহুমাত্রিক ও সর্বাধিক তথ্য সংগ্রহ ও ব্যাপক, বিসত্মৃত অনুধাবন সম্ভব৷ হ্যাজেল বার্জারের গবেষণা ধারা, পদ্ধতি অনুসরণ কওে নিম্নলিখিত ধারায় লোক ও কারম্নশিল্পের গবেষণা, বিশেস্নষণ ও মূল্যায়ন করা যেতে পারে৷
(১) নির্দিষ্ট লোক ও কারম্নশিল্পের বিসত্মারিত ও বিজ্ঞানসম্মত বিশেস্নষণ ও মূল্যায়ন৷
(২) লোক ও কারম্নশিল্পের ব্যক্তি শিল্পী, কারিগরের জীবন বিশেস্নষণ ও মূল্যায়ন৷ বাংলাদেশের লোক ও কারম্নশিল্পের অনত্মর্ভূক্ত চিত্রিত হাঁড়ির গবেষণা, বিশেস্নষণ ও মূল্যায়নে উপরিউক্ত দুটি পদ্ধতি ও ধারায় সম্পন্ন করা যেতে পারে৷ এই গবেষণা পদ্ধতি ও ধারায় বাংলাদেশের লোকজীবনের মানুষের জীবনযাপনসম্বন্ধীয়-সংস্কৃতিবিষয়খ লোক ও কারম্নশিল্প চিত্রিত হাঁড়ির জাতিতাত্তি্বক নিরিখে বিশেস্নষণ ও মূল্যায়ন বিজ্ঞানসম্মত, সার্বিক ও বহুমাত্রিকগুণ সম্পন্ন হবে৷
ঊাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের চিত্রিত হাঁড়ির স্থানিক ও কালিক ব্যবধানে, এর পার্থক্য ও বৈশিষ্ট্যেও স্বরূপ উদঘাটনে এবং দেশের সংস্কৃতির রূপ অন্বেষণে লোকশিল্পের জাতিতাত্তি্বক বিশেস্নষণ ও মূল্যায়ন এক নতুন দিকনির্দেশনা প্রদানে সহায়ক ভ্থমিকা পালন করবে৷

লোকজউত্‍সব, মেলা

লোকজীবনধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত লোকসমাজের প্রথা, অভ্যাস রেওয়াজ, সামাজিক রীতিনীতি (পঁংঃড়স) মূলতঃ অতিপ্রাকৃত শক্তি, দৈববাণী, জাদুবিদ্যা প্রভৃতি অন্ধ বিশ্বাস ও সংস্কৃতিসংশিস্নষ্ট৷ লোকসমাজের প্রথায়, অভ্যাসে তার স্ফ্থরণ ঘটে৷ ফলে (পঁংঃড়স) সামাজিক প্রথা, অভ্যাস, রেওয়াজের সঙ্গে (ংঁঢ়বত্‍ংঃরঃরড়হং) অন্ধ বিশ্বাসের একটা ঘনিষ্ট সম্পর্ক রয়েছে৷ অন্ধ বিশ্বাসের মতো সামাজিক প্রথাতেও লোকসংস্কৃতির বাকজাতীয় (াবত্‍নধষ) ও বস্তুজাতীয় (হড়হ াবত্‍নধষ) উপাদান বর্তমান৷ লোকসাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সুনির্দিষ্ট অবস্থায় তা প্রয়োগযোগ্য৷
মূলতঃ লোকজীবনে (ভড়ষশ ষরভব) কোন লোকসমাজের মানুষের ঐতিহ্যিক দিক লোকসাহিত্য, লোক সঙ্গীত, আচার- আচরণ, অনুষ্ঠান, বিশ্বাস এবং বস্তুজাতসংস্কৃতি-লোক কারম্নশিল্প৷ এ কারণে লোকজীবনের অনত্মর্ভূক্ত প্রথা (পঁংঃড়স) লোকসমাজের মানুষের গোষ্ঠীকেন্দ্রিক বার্ষিক আমোদের, আনন্দেও অনুষ্ঠান- উত্‍সবের গুরম্নত্ব সাংস্কৃতিক, জাতিতাত্তি্বক৷ বার্ষিক আমোদ ও আনন্দকেন্দ্রিক উত্‍সবের যে প্রথা রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম নবান্ন, নববর্ষ এবং পৌষউত্‍সব, মেলা৷ এছাড়া ধর্মীয় ঈদ, মহরম, বিভিন্ন পূজা, চৈত্র সংক্রানত্মি উপলৰে আয়োজিত উত্‍সব মেলা৷ এসব দিনে উত্‍সব, মেলা আয়োজনের ঐতিহ্যিক প্রথা আমাদের লোকজীবনের ঐতিহ্য৷ এভাবেই গ্রামীণ লোকজীবন ধারার অবিচ্ছেদ্য অংশ লোকমেলা৷ প্রতি বছর নানা পাল-পার্বণে ধর্মীয় উত্‍সবকে ঘিওে আয়োজিত লোকমেলার রয়েছে লোকজীবনের আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক গুরম্নত্ব৷ লোকজীবন ধারার পরিচায়ক বস্তুজাত সংস্কৃতির বস্তু-লোক ও কারম্নশিল্পের প্রসার, উত্‍কর্ষ, যোগাযোগ, বাজার ও সমন্বয়ের ৰেত্র লোক মেলা৷ উপলৰ্য হিসেবে কখনো ধর্মীয়, কখনো কৃষিভিত্তিক জীবনের আচার অনুষ্ঠানগত রূপের পরিসীমায় মেলা আয়োজন করা হয়৷ এভাবেই মেলা একটি ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে৷
এছাড়া আবহমানকাল হতে বাংলাদেশের স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামীণ লোকজীবনের সার্বিক উন্নয়নকে মেলায় তুলে ধরা, ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা হয়৷ সেই সঙ্গে লোকসমাজের সকল সত্মরের বয়সের মানুষের মধ্যাকার একটি বাসত্মব যোগাযোগ, যার মধ্যে অনত্মর্ভূক্ত রয়েছে আর্থ- সামাজিক-সাংস্কৃতিক দিক৷ ফলে মেলা হয়েছে আমাদের দেশের গ্রামের সাধারণ মানুষের আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের কেন্দ্র এবঙ আবালবৃদ্ধবনিতা সকলের অতি পরিচিত, প্রাণের, জীবনের আনন্দের ৰেত্র৷ এভাবে গ্রামের সাধারণ মানুষের সস্কৃতির লালন, রূপানত্মরের ৰেত্রই বলা চলে মেলাকে৷
বাংলাদেশের মেলা এদেশের মানুষের গোষ্ঠীগত চেতনার নানা প্রাচীন অনুষঙ্গ, চিত্র, বৈশিষ্ট্য, বৈশিষ্ট্যেও নানা দিকের অজানা তথ্য, তত্ত্ব আবিষ্কারের অশেষ ৰেত্র৷ মেলা ধর্মীয় বা ধর্মনিরপেৰ যে ধরনেরই হোক না কেনো গ্রামীণ পরিবেশের মানুষের দ্বারা গঠিত গোষ্ঠির আশা আকাক্সখা, উন্নয়ন, মেলার চরিত্রকে নিয়ন্ত্রণ কওে থাকে৷ অর্থাত্‍ লোকসমাজের চাহিদার উপর ভিত্তি করেই মেলার চালচিত্র,বৈশিষ্ট্য সৃজিত হয়ে থাকে৷ জীবনের প্রাত্যহিকতাকে পরিপূর্ণ করতে একদিকে কৃষি উপকরণ, অপরদিকে দৰ হাতের তৈরি বস্তু, দ্রব্য-লোক ও কারম্নশিল্পের বিনিময়, লেনদেন মেলার একটি বড় কার্য়ক্রম৷
আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রেৰিতে লোকজীবনে ব্যক্তি মানুষের অবস্থান, চলার পথে মেলা এবং সামগ্রিক অগ্রগতি ও উন্নয়নকে অবলোকন করার আনুষ্ঠানিক আয়োজন হচ্ছে লোকমেলা৷ লোকসংস্কৃতির সাংস্কৃতিক উপাদান, অবস্থা বস্তুজাতসংস্কৃতি- লোক ও কারম্নশিল্পের প্রসার ও আদান প্রদানের ৰেত্র লোকমেলা বাংলাদেশের মানুষের লোকজীবনধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত৷
বাংলাদেশের লোকজীবন এদেশের প্রাকৃতিক পরিবেশের বৈশিষ্ট্য ও সীমারেখায় সৃষ্ট কৃষিব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল৷ লোকজীবন ধারার এই প্রধান বৈশিষ্ট্য নিয়েই এদেশের লোকসংস্কৃতি, বস্তুজাতসংস্কৃতির গড়ন, রূপ নির্ধারিত হয়েছে৷ গ্রামীণ কৃষিজীবন ভিত্তিক, লোকজীবনধারার প্রয়োজনীয় বস্তুজাতসংস্কৃতির লোক ও কারম্নশিল্প এদেশের প্রাকৃতিক পরিবেশের সহজলভ্য উপাদান, কাঁচামাল, উপকরণে তৈরি৷ লোকজীবন ধারায মানুষের জন্ম হতে মৃতু্য পর্যনত্ম যা কিছু প্রয়োজনীয় বস্তু-বস্তুজাতসঙস্কৃতি-লোক ও কারম্নশিল্পের অনত্মর্ভ্থক্ত৷ এর শ্রেণীকরণ এভাবে হতে পারেঃ
১. কৃষি কাজের সরঞ্জাম ঃ লাঙ্গল, বাঁশের ঝুড়ি, ধানের গোলা, ধান চাল মাপার বাঁশের, বেতের কাঠা, বাঁশের, বেতের মাথাল, ঢেকি, কুলা, বাঁশের খালই, ধামা৷
২. গার্হস্থ্য জীবনের প্রয়োজনীয় জিনিস ঃ মাটির হাঁড়ি, পাতিল, কলসি, শানকি, বাটি, গামলা, চাবি, কাঠের চামচ, তালপাতার ও বাঁশের-বেতের পাখা, বাঁশের ঝুড়ি, কাঠের বাক্স, পাটের সিকা, শীতলপাটি, হোগলা, মাদুর, শতরঞ্জী, প্রদীপদানী৷
৩. বাসস্থানের জন্য ঃ মাটির, বাঁশের, বাঁশ-ছনের ঘর৷ বাঁশের বেড়া, বেলকি, দরমা, কাঠের দরজা, জানালা, চৌকাঠ৷
৪. বস্ত্র পরিচ্ছদ ঃ সুতিবস্ত্র, শাড়ী, লুঙ্গী, ধুতি, নকশী কাঁথা, গামছা, ফতুয়া৷ এবং উপজাতি ও আদিবাসীদের পোশাক, পরিচ্ছদ৷
৫. যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রয়োজনে ঃ নৌকা, গরম্নর গাড়ী, পাল্কী৷
৬. মানুষের সৌন্দর্যবোধ সংক্রানত্ম ঃ বাঁশের বাশী, ঢোল, কারম্নকার্যময় কাঠের, বাঁশের জিনিস, একতারা, দোতারা, বাদ্যযন্ত্র৷
৭. শিশুদের আনন্দ বিধান ঃ মাটির পুতুল, বাঁশের, কাঠের খেলনা, হাতী, ঘোড়া, পুতুল, গরম্নর গাড়ী৷
৮. ধর্মীয়, লোকজ বিশ্বাস ঃ মাটির কাঠের তৈরী প্রতিমা, মূর্তি, কাঠের মূর্তি, মাটির তৈরী লৰীসরা৷ পাটি-জায়নামাজ, কোরানের গিলাফ, পটচিত্র৷
৯. সাধারণ আসবাব ঃ জলচৌকি, কাঠের পিড়ি, কাঠের বাক্স, কাঠের তাক, বাঁশের, বেতের বাক্স, ঝুড়ি৷
১০. অঙ্গের সাজ সজ্জা ঃ লোক অলঙ্কার, পুতির মালা৷
বাংলাদেশের লোকজীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ লোকজউত্‍সব, মেলা এদেশের বস্তুজাত সংস্কৃতি-লোক কারম্নশিল্পের কেন্দ্র৷ এই ঐতিহ্য আমাদের সংস্কৃতির ঐতিহ্য৷ অর্থাত্‍ হাজার বছর ধরে বাংলাদেশের বস্তুজাত সংস্কৃতি লোক কারম্নশিল্পের বিক্রয় ও প্রসারের কেন্দ্র লোকজ উত্‍সব, মেলা৷ লোকজ উত্‍সব ও মেলা যেমন আমাদের সাংস্কৃতিক উপাদান এবং সেই সঙ্গে এক ধরনের সাংস্কৃতিক অবস্থাও বটে৷ বস্তুজাতসংস্কৃতি-লোককারম্নশিল্প আমাদের দেশের লোকজীবনধারা- সংস্কৃতির অবকাঠামো সৃষ্টির কাজটি কওে থাকে৷ সেই সঙ্গে লোকজীবনধারা-লোকসংস্কৃতির বাকজাতীয় সাংস্কৃতিক উপাদান-সংস্কৃতির উপরিকাঠামোকেও যুগপত্‍ ধারণ করে৷ জাতীয়সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, এর স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে বস্তুজাতসংস্কৃতির-বস্তু লোককারম্নশিল্পের মূল্য, গুরম্নত্ব অপরিসীম৷ বস্তুতঃ বস্তুজাতসংস্কৃতি লোককারম্নশিল্প লোকসমাজের মানুষের লোকজীবনধারা-লোক সংস্কৃতিকে ধারণ করে৷ এজন্য বস্তুজাতসংস্কৃতির বস্তু, লোককারম্নশিল্প জাতিতাত্তি্বক৷ এর বিশেস্নষণ ও মূল্যায়নের জন্য প্রথমে বস্তুজাতসংস্কৃতির অনত্মর্ভূক্ত বস্তু লোককারম্নশিল্পের অসংখ্য নমুনার দলিলীকরণ করা অপরিহার্য৷ আঞ্চলিক-স্থানিক, ও কালিক ব্যবধানে বহু বিচিত্র ধরনের অসংখ্য বস্তুজাতসংস্কৃতি-লোককারম্নশিল্প ক্রমাগত সাংস্কৃতিক রূপানত্মর প্রক্রিয়ায় রূপানত্মরিত হয়ে চলমান, অব্যাহত রয়েছে৷ বাংলাদেশের ঐতিহ্যের লোক জীবনধারায় আজ অবধি ক্রমপুঞ্জিত ভাবে রূপানত্মরিত ধারাবাহিক রূপকে বস্তুজাতসংস্কৃতির বস্তু, লোককারম্নশিল্প ধারণ কওে সচল, অব্যাহত রয়েছে৷
লোকজউত্‍সব ও মেলায় বস্তুজাতসংস্কৃতি-লোককারম্নশিল্পের উলিস্নখিত লোকজীবনধারাকেন্দ্রিক দৈনন্দিন ব্যবহার্য বহু বিচিত্র জিনিস কেনা বেচা, লেনদেন হয়ে থাকে৷ এই নিয়ম ও ধারাটিও আমাদের লোকসাংস্কৃতির ঐতিহ্যের প্রথা, রেওয়াজ এবং সংস্কার৷ আবহমান কাল হতে আজ অবধি আমাদেও দেশের ধর্মনিরপেৰ বা ধর্মীয় সকল উত্‍সব, মেলায় এক এবং অভিন্ন ঐতিহ্য অনুসৃত হচ্ছে৷ এবং লোকজউত্‍সব, মেলা আমাদের লোকসমাজের লোকজীবনধারার সাংস্কৃতিক পরিচয়বাহী বস্তুজাতসংস্কৃতি-লোককারম্নশিল্পের প্রদর্শন, প্রসার বাজারের আদর্শ কেন্দ্র৷ বাংলাদেশের লোকজীবনধারা-লোকসংস্কৃতির প্রবহমান ধারাটি এখনো এদেশের গ্রামের মানুষের অনুভব চেতনায়, জীবনযাপনে সক্রিয়৷ ফলে লোকজীবনধারা-লোকসংস্কৃতির তাগিদ, প্রথা, নিয়ম, রেওয়াজ লোকজউত্‍সব মেলাকে একটি সংস্কার হিসেবে আবহমান কাল হতে আজ অবধি আয়োজন করা হয়৷ লোকজউত্‍সব, মেলার এই আয়োজন ঐতিহ্যিক ধারার পাশাপাশি স্থানিক ও কালিক ব্যবধানে নবনব রূপে লোকজ উত্‍সব, মেলা আমাদেও জাতীয় সাংস্কৃতিক পরিন্ডলে রূপলাভ করে চলেছে৷

Friday 20 November 2009

ভাস্কর্য

গুপ্তযুগে ভাস্কর্য উন্নতির চরম শিখরে উপনীত হয়েছিলো৷ এ যুগে হিন্দু বৌদ্ধ দুই রকম মুর্তিই তৈরী হয়েছিলো৷ বুদ্ধমুর্তি এ সময়ে পূর্ণরূপ পায়৷ এ যুগের ভাস্কর্যের আরেকটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো এর আধ্যাত্মিকতা৷ এ যুগে ভাস্কর্যে যে বৈশিষ্ট্যগুলো চোখে পড়ে _ ভাস্কর্যগুলোর কাঁধের দুইদিক কাপড়ে ঢাকা৷ মাথাটি সম্পূর্ণরূপে কোকড়ানো চুল দিয়ে আবৃত৷ চোখের পাতা অর্ধ-নিমীলিত _ যা দেখে মনে হয় বুদ্ধ পার্থিব জগত্‍ হতে অনেক দূরে৷ মাথার পেছনে প্রভামন্ডলে রয়েছে পদ্মপাতা এবং তাকে াঘরে রয়েছে জ্যামিতিক নকশা৷
এছাড়াও বুদ্ধমুর্তিতে কয়েকপ্রকার মুদ্রা দেখাযায় _
১. ধ্যানমুদ্রা (দুই কোলের উপর ন্যসত্ম)
২. ভূমি স্পর্শ মুদ্রা
৩. ধর্মচক্র মুদ্রা (দুই হাত বুকের উপর ন্যসত্ম)
৪. অভয় মুদ্রা
গুপ্তযুগে এক বিশেষ ধরনের মুর্তি পাওয়া যায় যার নাম ঐতিহাসিকগণ দিয়েছেন ভেজাবুদ্ধ৷ মুর্তিগুলো দেখলে এর পরনের কাপড় ানিতে ভেজা মনে হয় বলে এরূপ নামকরন করা হয়েছে৷ মাথাবিহীন মুর্তির হাতের আঙ্গুলগুলি জোড়া লাগানো ছিলো (হাঁসের পায়ের মতো)৷ গুপ্তভাস্কর্যের এটি আরেকটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য৷
গুপ্তযুগে সারনাথে প্রাপ্ত ধ্যানমগ্নবুদ্ধ, মথুরায় প্রাপ্ত দন্ডায়মানবুদ্ধ, সুলতানগঞ্জে প্রাপ্ত বওদ্ধের তাম্রমুর্তি বৌদ্ধ ভাস্কর্য শিল্পের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন৷ এছাড়াও পৌরনিক উপাখ্যান অবলম্বনে কৃষ্ণ, বিষ্ণু, শিব প্রর্ভতি দেবতার অপূর্ব মুর্তি গুপ্ত যুগেই নির্মিত হয়েছিলো৷ এ যুগের ভাস্কর্যে বাসত্মবতার উপর ধর্মের প্রভাবের ফলে যে অতীন্দ্রিয় ভাবের সৃষ্টি হয়েছে তা গুপ্তযুগের শিল্পকলাকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছে৷
গুপ্তযুগে নির্মিত একটি গুরম্নত্বপূর্ণ শিল্পকর্ম হচ্ছে পঞ্চম শতাব্দীতে নির্মিত উপবিষ্ট বুদ্ধ৷ এটি ভারতের উত্তর প্রদেশের বেনারসের নিকট সারনাথ নামক স্থানে পাওয়া গেছে৷ এই মুর্তিটির উচ্চতা ৫ ফুট ৩ ইঞ্চি৷ এটি চুনা বালি পাথর দ্বারা নির্মিত৷ এটিকে গুপ্ত ভাস্কর্যের একটি আদর্শ মডেল হিসেবে চিহ্নিত করা যায়৷ এটিতে এক ধরনের সূক্ষ্ম সরলতা লৰ্য করা যায়৷ মুর্তিটির পশ্চাতে রয়েছে বিশাল প্রভামন্ডল৷ এখানে বুদ্ধ যোগাসনে উপবিষ্ট৷ ধর্মচক্র মুদ্রায় তার অবস্থান৷ তিনি যে আসনটিতে বসা তাতে নক্সা উত্‍কীর্ণ করা আছে৷ বিশাল প্রভামন্ডলের দু'পাশে রয়েছে দুটি উড়নত্ম দেবদূত৷ আসনের নিচে নির্মিত হয়েছে ছয়জন ভক্ত৷
ভারতের বিহার প্রদেশের সুলতানগঞ্জে গুপ্তযুগের ধাতু নির্মিত একটি মুর্তি পাওয়া গেছে৷ এটির উচ্চতা ৭.৫ ফুট৷ এটির গড়নশৈলী সারনাথের বুদ্ধের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ৷
বুদ্ধমুর্তিছাড়াও এ সময়ে অনেক বৈদিক মুর্তিও নির্মিত হয়েছে৷ হিন্দু শিল্পকলার সংখ্যা এ যুগে কম নয়৷
গুপ্তযুগ শুধু ভারতীয় শিল্পের ক্লাসিকালযুগ নয়, এটি ভারতীয় সংস্কৃতির ক্লাসিকালযুগ৷ ভারতীয়শিল্প বলতে আমরা গুপ্তযুগের শিল্পকেই বুঝে থাকি৷

গুপ্তযুগ (৩২০ _ ৫৪৪খৃঃ)

খৃঃ তৃতীয় শতক ভারতে বিরাট রাজনৈতিক পরিবর্তনের যুগ৷ আনুমানিক ৩২০ খৃষ্টাব্দে বিহারে এক শক্তিশালী সাম্রাজ্যের পত্তন হয়৷ এই সাম্রাজ্যের নাম গুপ্ত সাম্রাজ্য৷ প্রথম চন্দ্রগুপ্ত ৩২০ খৃঃ পাটালীপুত্রে প্রথম গুপ্ত সাম্রাজ্যের বনিয়াদ প্রতিষ্ঠা করেন৷ চন্দ্রগুপ্তের পর তার পুত্র সমুদ্রগুপ্ত সিংহাসনে বসেন৷ সমুদ্রগুপ্তের পর তার পুত্র দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত সিংহাসনে বসেন৷ গুপ্ত বংশের শেষ শক্তিশালী রাজা ছিলেন বুধগুপ্ত৷ তিনি সম্ভবতঃ ৫০০ খৃঃ পরলোকগমন করেন৷ এরপর যারা রাজা হন তাদের সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না৷
গুপ্তরা ভারতের সর্বত্র এক বিশাল সাম্রাজ্যের পত্তন করে যা ভারতীয় শিল্পকলার ইতিহাসে এক গুরম্নত্বপূর্ণ ও অমর অধ্যায় রচনা করেছে৷ গুপ্তযুগের শিল্পকলাকে আমরা 'ধ্রম্নপদী শিল্পকলা' যুগ হিসেবে আখ্যায়িত করতে পারি৷
গুপ্তযুগে স্থাপত্য ভাস্কর্য এবং চিত্রকলা উন্নতির চরম শিখরে উপনীত হয়েছিলো৷ হিন্দু এবং বৌদ্ধ ধর্মের বিষয়বস্তুই ছিলো শিল্পের প্রধান উপাদান৷ যদিও গুপ্ত রাজারা ১৫০ বছর রাজত্ব করেছিলেন কিন্তু গুপ্ত সংস্কৃতির প্রভাব ভারতবর্ষে সপ্তম শতাব্দীর মেষভাগ পর্যনত্ম বিদ্যমান ছিলো৷ সাহিত্য, সঙ্গীত, শিল্প সবদিক দিয়েই গুপ্তযুগে ভারতীয় সংস্কৃতির পূর্ণতম বিকাশ হয়েছিলো৷ তাই একে স্বর্ণযুগ বলা হয়৷ এ যুগ শিল্পের আদর্শ বদলে গিয়েছিলো৷ গুপ্ত শিল্পকলায় বিদেশী প্রভাব থাকলেও শিল্পীরা একে নিজস্ব পরিভাষায় ব্যক্ত করেছেন৷
ভারতের অন্যান্য শিল্প বিশেষ যুগের বিশেষ প্রদেশের শিল্প কিন্তু গুপ্ত যুগের শিল্পকলা সারা ভারতের জাতীয় শিল্প, যা সর্বকালের জন্য সর্বদেশের জন্য৷ এখানে সম্পূর্ণরূপে ভারতীয় শিল্পাদর্শের এবং টেকনিকের সমন্বয় করা হয়েছে৷ মূলতঃ বহুযুগ ধরে ভারতের শিল্পের যে পরিৰন চলছিলো, তাই গুপ্ত শিল্পে দানাবেঁধে পূর্ণতাপ্রাপ্ত হয়েছে৷

Metarial Technique - Graphics Design


গ্রাফিক ডিজাইন বলতে কি বুঝো ?

গ্রাফিক শব্দটি ইংরেজীতে জার্মান গ্রাফিক হতে এসেছে। এর অর্থ ড্রইং বা রেখা। এই শব্দটি সেই সব চিত্র সমূহকে বুঝায় যে চিত্র সমূহের সফল পরিসমাপ্তি ড্রইং এর উপর নির্ভরশীল রং এর উপর নয়। গ্রাফিক অর্থ রেখা আর ডিজাইন অর্থ পরিকল্পনা বা নকশা। বর্তমানে গ্রাফিক ডিজাইন বলতে আমরা সেই সব চিত্র কর্মকে বুঝি যা পরবর্তীতে ছাপার জন্য তৈরী করা হয়।
গ্রাফিক ডিজাইন ও এর আওতাধিন বিষয় সমূহ :
গ্রাফিক ডিজাইন কথাটি গুটি কয়েক শব্দের মধ্যে হলেও এর ব্যাপকতা অনেক বেশী। বিশ্বের সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, ব্যবহারিক সবকিছুর মধ্যেই এই শব্দ দুটির বিচরণ অনস্বীকার্য। আমরা যা কিছুই করিনা কেনো তার একটা নান্দনিক উপস্থাপনার অবশ্যই প্রয়োজন। প্রচার এবং প্রসারের ক্ষেত্রে যে কোনো কিছুরই শিল্পসম্মত উপস্থাপনার জন্য যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন তা হলো গ্রাফিক ডিজাইন।
মূলতঃ যে সকল চিত্রের সমাপ্তিকরণ ড্রইং এর উপর নির্ভরশীল সে সকল চিত্র সমূহকে বুঝায়। সাধারণত ড্রইং ছবি বা কোনো ইমেজ এবং অক্ষর শিল্পই হচ্ছে গ্রাফিক ডিজাইন। এ সকল বিষয়গুলো নিয়ে বিভিন্ন স্পেসে এবং বিভিন্ন রং বা কখনো শুধুমাত্র এশটি দুটি রং দিয়ে তৈরী হয় এশটি ডিজাইন যা সাধারণত ছাপার জন্য তৈরী করা হয়।
বাংলাদেশে গ্রাফিক ডিজাইনের শুরু মূলত অষ্টাদশ শতাব্দির শেষার্ধ হতেই। বিলাত হতে ইংরেজদের স্তায় নিয়ে আসা প্রিন্ট দিয়েই ধরতে গেলে এ মাধ্যমটির যাত্রা শুরু।
গ্রাফিক ডিজাইম কথাটির সাথে বাণিজ্যের সরাসরি একটা যোগাযোগ লক্ষ্যণীয় অর্থাৎ ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যের জন্য বা বিষয়টির প্রচারই গ্রাফিক ডিজাইনকে উৎসাহিত করে। শুধু ব্যবসায়িক দিক নয় জনসচেতনতা, সামাজিক পরিচিতি নান্দনিক মূল্যবোধ এ সব কিছু নিয়েই গ্রাফিক ডিজাইন। মোট কথা শিল্পকলার যা কিছু ব্যবহারিক দিক তার সবকিছুই গ্রাফিক ডিজাইনের অন্তর্ভুক্ত। যেমন- ইলাস্ট্রেশন, বুক কভার, টাইপোগ্রাফি, ব্রুশিওর, স্টিকার, বিজ্ঞাপন, সিডি কভার, ডিজিটাল সাইন, ক্যলেন্ডার, মডার্ণ পেইন্টিং, ওয়েব ডিজাইন, সফটওয়্যার ডিজাইন, টেক্সটাইল ডিজাইন ইত্যাদি।
ডিজাইন কি ? বুঝিয়ে বলো।
ডিজাইন হচ্ছে কোনো নির্দিষ্ট ক্ষেত্রের উপর বস্তুর পরিকল্পিত অবস্থান। অর্থাৎ একটি ছবির সমাপ্তিকরণে নির্দেশকের ভূমিকা পালন করে যে নকশা বা ড্রইং তাকেই বলা হয় ডিজাইন। নকশা তৈরীর মূল সূত্র সমূহ সঠিক ভাবে অনুসৃত হলে একটি নকশার জন্ম হয়। সংক্ষেপে বলা যায় কোনো সৃজনশীল কর্মের প্রাথমিক কাঠামোই হচ্ছে ডিজাইন।
এলিমেন্টস অফ ডিজাইন কি কি ?
(১) কালার
(২) ডিরেকশন
(৩) লাইন
(৪) শেপ
(৫) সাইজ
(৬) টেকচার
(৭) ভেল্যু
প্রিন্সিপল অফ ডিজাইন কি কি ?
১.অল্টারনেশন
২.ব্যালেন্স
৩.কন্ট্রাস্ট
৪.ডোমিনেন্স
৫.গ্রেডেশন
৬.হারমোনি
৭.রিপিটেশন
৯.ইউনিটি
গ্রফিক ডিজাইনের মাধ্যম কি কি ?
গ্রাফিক ডিজাইনে অনেক মাধ্যমে কাজ করা হয়। যেমন-পেন্সিল, চারকোল, গ্লাস মার্কার, ক্রেয়ন, প্যাস্টেল, চক, রং, কালি কলম, আলোকচিত্র, কম্পিউটার ইত্যাদি।
গ্রাফিক ডিজাইনের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম পেন্সিল সম্পর্কে যা যানো লিখো
গ্রাফিক ডিজাইনের সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম হচ্ছে পেন্সিল। আজ হতে প্রায় ৩৫০ বছর আগে প্রথম ইংল্যান্ডের একজন কাঠমিস্ত্রী এই পেন্সিল আবিষ্কার করেন। যার নাম ষ্টেডলার। শীষার সাথে ক্লে মিশিয়ে পেন্সিল তৈরী করা হয়। যে গাছের আঁশ লম্বালম্বি সে গাছের কাঠ দিয়ে পেন্সিল বানানো হয়। পেন্সিলের শীষে নানান ডিগ্রী থাকে। শক্ত হতে নরম। সাধারণত এইছ বি হতে ৬বি পর্যন্ত আমরা ব্যবহার করে থাকি। এইছ বি শক্ত এবং ৬বি নরম। শক্ত পেন্সিলে বেশী শীষা ক্লে কম, নরম পেন্সিলে শীষা কম ক্লে বেশী। পেন্সিল তিন ধরনের হয়ে থাকে। যেমন- ক্লাস পেন্সিল, টেকনিকাল পেন্সিল, উডেন পেন্সিল ইত্যাদি। বিভিন্ন ধরনের এই পেন্সিলের সাহায্যে একজন ডিজাইনার নকশা প্রণয়ন এবং সে নকশাকে পরিবর্তন, উন্নতকরন ও পরিবর্ধন করেন।
গ্রাফিক ডিজাইনের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম পেন সম্পর্কে যা যানো লিখো
গ্রাফিক ডিজাইনে পেন্সিলের মতো পেনও একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। গুহাচিত্র যখন আঁকা হয় তখন হতে পেনের উৎপত্তি ধরা হয়। তখন যে কোনো সরু জিনিস (গাছের ডাল) দিয়ে পুহার দেয়ালে রং লাগিয়ে ছবি আঁকা হতো। এরপর বাঁশ কেটে খাঁগের কলম, তারপর পাখির পালক ইত্যাদি।
পেনের প্রকারভেদ-
১. ক্রোকুইল নিব
২. ড্রাফটিং পেন/ টেকনিকাল পেন/ রেডিওগ্রাফ পেন
৩. ফাউনটেইন পেন
৪. সাইন পেন
৫. মার্কার পেন
৬. বল পয়েন্ট পেন
৭. জেল পেন
৮. বিভিন্ন নিব সেট :
(ক) রাউন্ড নিব
(খ) ফ্ল্যাট নিব
(গ) কোনিকাল নিব
(ঘ) ডিভাইডিং নিব
ইলাস্ট্রেশনে কালি কলমের ভূমিকা কি ?
লিখিত বা কথিত কোনো ঘটনাবলীর অংকিত চিত্রায়িত দৃষ্টিগ্রাহ্য রুপ হচ্ছে ইলাস্ট্রেশন। যে গল্প বা কবিতা নিয়ে ইলাস্ট্রেশন করা হবে একজন ইলাস্ট্রেটর তা ভালোভাবে পড়ে তার অন্তর্নিহিত ভাব নিয়ে সেই বিষয়ের উপর চিত্র অংকন করবেন। যার জন্য প্রয়োজন হবে বিভিন্ন মাধ্যম। তার মধ্যে প্রধান একটি মাধ্যম হচ্ছে পেন। পেনের বিভিন্ন লাইন ডট ব্যবহার করে একজন ইলাস্ট্রেটর তার ইলাস্ট্রেশন করে থাকেন-
ডট ওয়ার্ক
লাইন ওযার্ক
ক্রস লাইন
কার্ভ লাইন
স্ট্রেইট ব্রোকেন লাইন
কার্ভ ব্রোকেন লাইন
ইন্টারসেপ্টিং কার্ভ লাইন
রং এর অর্থ কি ?
মৌলিক রং চারটি। লাল, নীল, হলুদ, কালো। এছাড়াও অনেক যৌগিক রং আছে যার অর্থ আলাদাভাবে চিহ্নিত করা হয়।
লাল- উত্তেজনা, উষ্ণতা, দীপ্তি
নীল- প্রশান্তি, শীতলতা, মোহনীয়তা
কালো- শোক
সাদা- শান্তি, পবিত্রতা
হলুদ- শুভ, উজ্জ্বলতার প্রতীক
সবুজ- জীবন, তারুণ্য, সজীবতা, প্রাচুর্য্য
কমলা- হৃদয়াবেগ, কামনা, নৈকট্য
বেগুনী- মহত্ববোধ
উজ্জ্বল হলুদ- ধর্মীয় আবেগ
গেরুয়া- ত্যাগ
সোনালী- সমৃদ্ধি, স্বাস্থ্য, জ্ঞান, প্রজ্ঞা, ঐশ্বর্য্য
ধূসর- উদাসীনতা, বিস্তৃতি
এয়ার ব্রাশ কি ?
গ্রাফিক ডিজাইনের একটি উল্লেখযোগ্য মাধ্যম এয়ার ব্রাশ। ১৮৯৩ সালে ব্রিটিশ চার্লস বার্ডিক এয়ার ব্রাশ আবিষ্কার করেন। সূক্ষ এবং মসৃণ কাজ করার জন্য এয়ার ব্রাশ ব্যবহার করা হয়। এয়ার ব্রাশ চালানোর জন্য প্রয়োজন হয় একটি কম্প্রেসর। যে কম্প্রেসরের সাহায্যে বাতাস সৃষ্টি হয়ে স্প্রে গানে প্রবাহিত হয়। স্প্রে গানের উপর রঙের বাটি থাকে এবং একটি কন্ট্রলার থাকে যে কন্ট্রলার উপর-নিচ চেপে স্প্রে করা হয়। যে সারফেসে স্প্রে করা হবে তার বাকি অংশ মাসকিন করে নিতে হবে। সূক্ষ কাজের জন্য বার্তি সুঁই থাকে। যে কোনো বিগনেট, টেক্সচার এবং সূক্ষ কাজের জন্য একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে এয়ার ব্রাশ অবশ্য এথন যা কম্পিউটার গ্রাফিক্সে সম্ভব।
এ-ফোর সাইজ কি ?
“এ” সিরিজের কাগজের মাপের এই নিয়ম প্রথম জার্মানীতে চালু হয় ১৯২২ সালে। সাইজের এই পদ্ধতিকে এমনভাবে হিসেব করে বার করা হয়েছে যে প্রতিটি সাইজ পূর্ববর্তী সমান দুটো অংশে বিভক্ত হয়ে যায়। জ্যামিতিকভাবে একই মাপে বিভক্ত হবে। এ-০ হচ্ছে ১ স্কয়ার মিটারের সমান। এ-৪ সাইজের মাপ দাড়ায় ৮.৩” ী ১১.৭”। বর্তমানে বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই সাইজটি খুব জনপ্রিয়।
¬কাগজের মাপ-
১. এ-৪ = ৮.৩” >< ১১.৭”
২. রয়েল সাইজ = ২০” >< ২৫“
৩. ইম্পেরিয়াল সাইজ = ২২” >< ৩০”
৪. ডাবল ক্রাউন (পোস্টার সাইজ) = ২০” >< ৩০”
৫. ফুল স্কেপ = ১৩.৫” >< ১৭”
৬. ডেমি সাইজ = ১৮“ >< ২৩”
৭. ডাবল ডেমি সাইজ = ২৩” >< ৩৬”
একটি পোস্টার কিভাবে তৈরী করা হয় আলোচনা করো :
একটি পেস্টার সাধারণত প্রচার, ঘোষণা এবং জনসচেতনতার জন্য করা হয়ে থাকে। বিভিন্ন রং, সাইজ ও মিডিয়ার পেস্টার হতে পারে।
পোস্টার দুই রকমের -
১. ইনডোর বা ডোমেস্টিক পোস্টার
২. আউটডোর বা স্ট্রিট পোস্টার
ডমেস্টিক পোস্টার হচ্ছে অভ্যন্ত্যরীণ পোস্টার এবং স্ট্রীট পোস্টার হচ্ছে বাইরে অর্থাৎ রাস্তার দেয়ালে যে সব পোস্টার লাগানো হয়। একটি পোস্টার তৈরী করতে হলে নিম্নলিখিত বিষয়গুলি জানা দরকার -
১. পোস্টারের মূল বিষয় (অর্থাৎ কি বিষয়ের উপর পোস্টার করা হবে)
২. বিষয়ের সংগতিপূর্ণ শিরোনাম
৩. বিষয় (আনুষাঙ্গিক তথ্যাদি)
৪. প্রকাশক বা সংশ্লিষ্ট সংস্থার নাম
৫. কি মাধ্যমে ছাপা হবে
৬. রং
৭. আকার
৮. ফ্লাশ কাট বা বর্ডার
৯. ভিজুয়ালাইজেশন (বিন্যাস করণ)
১০. হাতে আঁকা ছবি বা ফটোগ্রাফ
১১. কম্পিউটার গ্রাফিক্স
একটি মাস্টার ডিজাইন কিভাবে ছাপার উপযোগী করা যায় বিভিন্ন স্তরগুলো আলোচনা করো।
প্রথম পর্যায়ে ডিজাইনটিতে কয়টি রং সেই কয়টি (কী) ড্রইং বের করতে হবে। (বর্তমানে কী ড্রইং বের করতে হয় না কম্পিউটার সিস্টেম ওয়ার্কের মাধ্যমে কালার সেপারেশন করে পজিটিভ বের করা হয়)। যেমন সায়ানের একটি, মেজেন্টার একটি, ইয়োলোর একটি ও ব্লাকের একটি। ট্রেসিং এ কী ড্রইং করতে হবে বা পজিটিভ করতে হবে। ইমেজের ক্ষেত্রে ক্যামেরার এক্সপোজ দিয়ে আলাদা আলাদা কালারের পজিটিভ করা হয়। পজেটিভ করার আগে খেয়াল রাখতে হবে কাগজের মাপ অনুযায়ী গ্রিপার মার্কের জন্য ০.৫ ইঞ্চি জায়গা রাখতে হবে। গ্রিপার হচ্ছে একটা রঙের পর পরবর্তী রঙের রেজিস্ট্রেশন মেলানোর জন্য।
একজন ডিজাইনার কম্পিউটারকে কিভাবে কাজে ব্যবহার করেন ?
বর্তমানে কম্পিউটার হচ্ছে একজন ডিজাইনারের গুরুত্বপূর্ণ একটি মাধ্যম। একটি ডিজাইন তৈরী হতে শুরু করে পজেটিভ, প্লেট এবং ছাপা পর্যন্ত কম্পিউটারের সাহায্য নিয়ে থাকেন। ডিজাইনার দুটি মাধ্যমে একটি ডিজাইন সম্পন্ন করতে পারেন- ১.হাতে একে তা কম্পিউটারে ইম্পোর্ট করে পরিবর্তন, পরিমার্জন ও পরিবর্ধন ২.সম্পূর্ণটাই কম্পিউটারের সাহায্যে। কারণ হাতে একটি কাজ করতে যে টুলস এবং রং ইত্যাদি প্রয়োজন হয় তা সবকিছুই গ্রাফিক্স সফ্টওয়্যার ফটোশপ, ইলাস্ট্রেটর, কোয়ার্ক এক্সপ্রেসে দেয়া আছে। এমনকি হাতে যে কাজগুলি সম্ভব না সেগুলোও দেয়া আছে যা ব্যবহার করে সহজে এবং তাড়াতাড়ি একটি ডিজাইন সম্পন্ন করা সম্ভব। যেমন বিভিন্ন ধরনের টেক্সচার।
কম্পিউটারের পূর্ণাঙ্গ পরিচিতি :
সিপিইউ = সেন্ট্রাল প্রসেসিং ইউনিট
র‌্যাম = র‌্যানডম এক্সেস মেমোরি
বায়োস = বেসিক ইনপুট আউটপুট সিসটেম
এজিপি = এক্সিলেটর গ্রাফিক্স পোর্ট
ইউপিএস = আনইন্টারাপটিবল পাওয়ার সিসটেম
আইপিএস = ইন্সটেন্ট পাওয়ার সিসটেম
ডিভিডি = ডায়নামিক ভিডিও ডিস্ক
রম = রিড অনলি মেমোরি
এইছডিডি = হার্ড ডিস্ক ড্রাইভ
এফডিডি = ফ্লপি ডিস্ক ড্রাইভ
ফ্রেন্স কার্ভ কি ?
ফ্রান্স কার্ভ হচ্ছে গ্রাফিক ডিজাইনের স্বচ্ছ প্লাস্টিকের ড্রইং এইড। এর দ্বারা ছন্দময় ও গতিশীল বক্ররেখা ও ঢেউ রেখার ড্রইং করা সম্ভব যা খালি হাতে করা সম্ভব নয়।
টেম্পেলেট কি ?
গ্রাফিক ডিজাইনে কাজ করার জন্য দরকার হয় বিভিন্ন ইন্সট্রুমেন্টের। এর মধ্যে টেম্পলেট হচ্ছে একটি। মেকানিকাল ড্রইং করার জন্য বিভিন্ন মাপের ত্রিভুজ, চতুর্ভূজ, বৃত্ত, সেটস্কয়ার, পিকটোগ্রাম প্রভৃতি কেটে শেপ বের করা স¦চ্ছ প্লাস্টিকের ড্রইং এইড হচ্ছে টেম্পলেট। বিভিন্ন শেপের ভেতরে ঘুরিয়ে আঁকা হয়, যে ড্রইংগুলো ফ্রিহ্যান্ড, কম্পাস, স্কেল বা কার্ভ দিয়ে আঁকা যায়না।
পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীনতম ইলাস্ট্রেশন কোনটি ?
পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীনতম ইলাস্ট্রেশন হচ্ছে মিশরীয় “বুকস অব দা ডেড” এবং রামেন্যাম প্যাপিরাস। আনুমানিক খ্রীস্টপূর্ব ১৯০০ শতকে অঙ্কিত।
পুস্তক চিত্রণে উন্নতি কোন শতক হতে ?
প্রথম বই ছাপা হয় পনেরো শতকে। একই কাষ্ঠখন্ডে ছবি এবং হরফ হাতে কেটে এতে ছাপা হয়। এই পদ্ধতি ব্লক বুকস নামে পরিচিত। এই পদ্ধতিই মূভেল টাইপ আবিষ্কারের পথিকৃৎ। পনেরো শতকের শেষ দিকে বইয়ে ছাপার হরফ ও ছবি আলাদা হয়ে যাওয়ায় ইলাস্ট্রেশনের উন্নতির সুযোগ বেড়ে যায়। এই শতকে কাঠ থোদাইয়ের ইলাস্ট্রেশন পূর্ণ মাত্রায় পুস্তকে ব্যবহৃত হয়। এরই ফলশ্রুতিতে ষোলো ও সতেরো শতকে তামার পাতে ছবি আঁকার প্রচলন ঘটে।
পুস্তক চিত্রণে লিথোগ্রাফের ভূমিকা কি ?
১৮ শতকে ব্রিটিশ ইলাস্ট্রেটর টমাস বিউহক এনগ্রেভিং পদ্ধতির উন্নতি সাধনে উড এনগ্রেভিং এ সূক্ষ কারুকাজ ও তার স্থায়িত্বের যথেষ্ট প্রসার ঘটান। তারপরই ঘটে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। ১৭৯৬ সালে জার্মান এলইস সেনে ফিল্ডার লিথোগ্রাফের উদ্ভাবন করেন। এতোদিন ছাপার কাজে ব্যবহৃত হতো উঁচু ভ’মির ব্লক। যার উপর কালি রাগিয়ে কাগজের উপর চাপ প্রয়োগে ছাপ নিয়ে ছাপার কাজ সারা হতো। কিন্তু লিথোগ্রাফি পদ্ধতির সূত্র হচ্ছে তেলে জলে মিশ খায়না। লিথোগ্রাফই হচ্ছে প্রথম প্লানোগ্রাফিক ছাপা অর্থাৎ সমতলীয় ছাপা পদ্ধতি যার অর্থ হচ্ছে সমতল ভ’মি হতে ছাপা। এই পদ্ধতিতে প্রথম উল্লেখযোগ্য বই হচ্ছে ১৮২৮ সালে প্রকাশিত ইউজিন দেলাক্রোয়া গ্যাটের নাটক “ফাউস্ট”। প্রথমত এই পদ্ধতি ছাপার কাজে ব্যবহৃত হত। কিন্তু এই পদ্ধতি ছবি আঁকার কাজে বিরাট সুযোগ এনে দেয়। পাথরে মসৃণ ভ’মিতে কালি, নানান ধরনের ক্রেয়ন এবং ওয়াশ ব্যবহারের বিচিত্র রকম পদ্ধতি বিশাল সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেয়। গয়া দামিয়েকের মতো শিল্পীরা পুস্তক চিত্রণে নানান পরীক্ষা নিরীক্ষা করেন। মার্ক শ্যাগালের চিত্রিত বইবেল চিত্রণে একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন।
প্যাপিরাস কি ? এর আবিষ্কার কোথায় ?
প্রাটীন মিশরে নলখাগড়াকে উচ্চ চাপে চ্যাপ্টা করে কাগজের পরিবর্তে লেখার কাজে ব্যবহার করা হতো। খ্রীস্ট জন্মের ২৫০০ বছর পূর্বে এর আবিষ্কার।
বিজ্ঞাপন কি?
আমেরিকান মার্কেটিং এসোসিয়েশন কর্তৃক প্রদত্ত বিজ্ঞাপন হচ্ছে, যে কোনো অব্যক্তিগত মূল্য প্রদানকৃত রূপ উপস্থাপনা এবং চিহ্নিত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক আয়োজিত মতাদর্শ, পণ্যসামগ্রী বা সেবায় তরান্বিত বিক্রয় প্রচেষ্টা।
তুলি কোথায় প্রথম আবিষ্কার ?
খ্রীস্ট জন্মের ২৫০ বছর পূর্বে চীন দেশে তুলির প্রচলন শুরু হয়। পশুর লোম দিয়ে তৈরী এ তুলি এখন অনেক রকমের আছে। চিকন লোমে সূক্ষè কাজ সম্ভব। মোটা তুলি, শক্ত তুলি রাফ কাজের জন্য ব্যবহৃত হয়।
মেকানিকাল ড্রইং কি ?
ছাপার পেলট তৈরীর আগে ছাপাবার সময় সমস্ত জিনিসপত্র যেমন লেখা, নকশা, ছবি যথাস্থানে বসিয়ে যে ড্রইং প্রস্তুত করা হয় তাকে মেকানিকাল ড্রইং বলা হয়। এই ড্রইং গ্রাফশিট ফেলে তার ওপর করা হয়।
ড্রপ আউট কি ?
প্রিন্টিং প্রসেসিং - এ নেগেটিভ হতে পজেটিভ করার আগে নেগেটিভের অবাঞ্চিত বা অনাকাঙ্খিত কোনো অংশকে ওপেক দিয়ে ঢেকে দেয়াকে ড্রপ আউট বলে। এই পদ্ধতিতে নেগেটিভ দেখে ছবির বা মেটারের কোনো শেড বা দাগকে অনায়াসে দুর করা যায়। অতঃপর পজেটিভ করা হলে প্রিন্টিং এ প্রার্থিত ফল আসে। এছাড়া কোনো জিনিসকে অর্থাৎ মেটারকে নেগেটিভে নতুন করে সন্নিবেশিত করতে চাইলে নির্ধারিত স্থানে ওপেক দিয়ে ঢেকে নতুন মেটার বা বিষয় পেস্ট করে পজেটিভ করা হয়। এই পদ্ধতিকেও ড্রপ আউট বলে।
সেন সেরিফ
যে ইংরেজী টাইপে ফিনিশিং ওরিয়েন্টমেন্ট তাকে বলে সেরিফ যে টাইপে ফিনিশিং থাকেনা তাকে বলে সেন সেরিফ। যেমন হেলভেটিকা, টাইমস
স্যাডল স্টিচ
বই, ব্রুশিওর, ম্যাগাজিন, ক্যাটালগ ইত্যাদি বাঁধাই করার অন্যতম পদ্ধতি। পৃষ্ঠার ভাঁজের বাইরের দিক হতে তার বা সুতা দিয়ে একত্র সেলাই করাকে স্যাডল স্টিচ বলে। এই সেলাই ফর্মা বাই ফর্মা হয়ে থাকে।
সেটস্কয়ার এঙ্গেল কত ডিগ্রি ?
১) ৪৫°, ৪৫°, ৯০°
২) ৩০°, ৬০°, ৯০°
বাংলা হরফের নকশা কে প্রথম উদ্ভাবন করেন ?
বিভিন্ন হস্তাক্ষর ও পুঁথির হরফ হতে আকৃতি ও রেখাগত সাদৃশ্য দিয়ে বাংলা হরফের নকশা প্রস্তুত করেন চার্লস উইলকিনস। তার নকশা অনুযায়ী ধাতুতে কেটে হরফ তৈরী করেন পঞ্চানন কমর্মকার।
বাউ হাউস কি ?
এটি একটি জার্মান শব্দ। জার্মান ভাষায় এর অর্থ বিল্ডিং হাউস প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় জার্মানে প্রতিষ্ঠিত বিখ্যাত ডিজাইন স্কুল। ১৯১৯ সালে জার্মানির ওয়াইমার শহরে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠাতা হলেন বিখ্যাত স্থপতি ওয়াল্টার গ্রোপিয়াস। বাউ হাউস সম্পর্কে গ্রোপিয়াসের মন্তব্য ছিলো -
“আমরা মেশিনের সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করতে চাই”।
এই বাউ হাউস হতে যে নকশা তৈরী হতো তা স্থাপত্য ও ভিজুয়্যাল ডিজাইনের ক্ষেত্রে এক নতুন মাত্রা তৈরী করেছিলো। পরবর্তীতে ১৯৩২ সালে জার্মানির বার্লিন শহরে স্থানান্তরিত হয়। এরপর নাজিরা গভর্নমেন্ট স্কুলটি বন্ধ করে দেন এবং এখানকার ছাত্ররা আস্তে আস্তে আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়ে। এরাই পরে ডিজাইনার হিসেবে খ্যাতি অর্জন করে। গ্রাফিক ডিজাইনে এই বাউ হাউসের প্রভাব সারা পৃথিবীতে গভীরভাবে পড়েছিলো।
মিল্টন গ্লেজার
আমেরিকার একজন প্রথম সারির গ্রাফিক ডিজাইনার। তার পুশপিন স্টুডিও গ্রাফিক ডিজাইনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সূচনা করে। বাউ হাউসের মতো পুশপিন স্টুডিও গ্রাফিক ডিজাইনে একটি মাইল ফলক।
বাংলা বই সচিত্রকরণে আদিবাসী শিল্পী কারা ছিলেন ?
বাংলা গ্রন্থচিত্রণে আদি পর্বে মূলত শিল্পী বলতে কেউ ছিলোনা। যেহেতু আদিতে গ্রন্থচিত্রণে ছবি ব্লক করে ছাপাতে হতো তাই প্রকাশকরা স¦রণাপন্ন হতেন স্বর্ণকার ও কর্মকারদের কাছে যারা খোদাই শিল্পে কিঞ্চিত ধারণা পোষণ করেন। জীবিকার প্রয়োজনে তাদের আয়ত্ব করতে হয় ধাতু খোদাই। ধাতু খোদাইয়ের চেয়ে কাঠ থোদাই সহজ। স্বভাবতই তারা কাঠ খোদাই শিল্পে অধিক মনোযোগী হন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য শিল্পী হলেন রামচাঁদ রায় ও কাশীনাথ মিস্ত্রী।
শিশুগ্রন্থ চিত্রণে বাংলাদেশে যারা অগ্রণী ভ’মিকা পালন করেছে তাদের সম্পর্কে যা জানো লিখো।
বাংলাদেশের শিশুগ্রন্থ চিত্রণ যাদের হাত দিয়ে শুরু হয়েছে এবং সমকালীন ইলাস্ট্রেশনে যাদের বিশেষ অবদান তারা হলেন -
১.কাজী আবুল কাশেম ২.হাশেম খান
৩.কামরুল হাসান ৪.কাইয়ুম চৌধুরী
৫.আবুল বারক আলভী ৬.রফিকুন নবী
৭.ফরিদা জামান ৮.মামুন কায়সার
৯.প্রানেশ মন্ডল ১০.বীরেন সোম
১১.ধ্রুব এষ প্রমুখ
এসকল শিল্পীরা বিভিন্ন মিডিয়াতে স্বকীয় বৈশিষ্ট্যতায় গ্রন্থ চিত্রণ করেছেন। এক একজন এক এক স্টাইলে কাজ করেছেন।
কাজী আবুল কাশেম : তার বেশীর ভাগ ইলাস্ট্রেশন রুপ কথার গল্প।
(ক) হাতেম তাই (খ) বাণিজ্যেতে যাবো আমি (গ) কাচা মিঠে (ঘ) সবুজ ছায়া (ঙ) গামা মামার সারে গামা (চ) কাজলা পুষি (ছ) জাম্বো ভাজে ডাম্বেল।
কামরুল হাসান : শিল্প সৃষ্টির প্রাতিষ্ঠানিক পাঠ নেয়ার জন্য তিরিশের মেষে কামরুল হাসান (১৯২১ ১৯৮৮) কলকাতার গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টসে ভর্তি হন। বাংলাদেশের চিত্রশিল্প যে তিনটি ধারায় প্রবাহিত হচ্ছে তার অন্যতম ধারার একটির (লোকজ ধারা) প্রধান ও শেষ পুরুষ শিল্পী কামরুল হাসান। এই লোকজ ধারার প্রবর্তক হিসেবে দেশবরেণ্য শিল্পী কামরুল হাসান স্বরণীয় হয়ে আছেন।
বাংলাদেশের আর্ট কলেজের প্রতিষ্ঠালগ্ন হতে গ্রাফিক ডিজাইন বিভাগের দায়িত্বে নিয়োজিত শিল্পী কামরুল হাসান (১৯৪৮) বিসিকে দীর্ঘদিন চাকুরি করেছেন। এই সময় তিনি প্রচুর কমার্শিয়াল কাজ করেছেন। পচ্ছদ, পেস্টার বিভিন্ন মনোগ্রাম সহ অনেক কাজ করেছেন। তার উল্লেখযোগ্য পোস্টার হচ্ছে “এই জানোয়ারকে হত্যা করতে হবে”। উল্লেখযোগ্য মনোগ্রাম হচ্ছে -
১.বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স
২.বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন
৩.বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা
লোকজ ধারায় কামরুল হাসান কাজ করেছেন -
(ক) রাজ কন্যে কঙ্কাবতী (খ) শিরণী
কাইয়ুম চৌধুরী :
(ক) দাপু সোনার জন্য (খ) মাঠ পাড়ের গল্প (গ) তাই তাই তাই
রফিকুন নবী :
(ক) ছুটির দিনে (খ) পানকৌড়ি (গ) গ্রামের নাম চৌগাছি (ঘ) গোলাপ ফুটে খুকীর হাতে
হাশেম খান :
পেনের মাধ্যমে ড্রইং স্কেচ এই স্টাইলে সবচেয়ে বেশী কাজ করেছেন শিল্পী হাশেম খান। তার উল্লেখযোগ্য বিষয় এনিমেল স্টাডি। কলকাতার বিমল দাশ যেমন বালাদেশের হাশেম খান তেমনি। শিশুদের পাঠ্য বইয়ে অসংখ্য ইলাস্ট্রেশন তিনি করেছেন -
(ক) এক যে ছিলো নেংটি (খ) সোজন বাদিয়ার ঘাট (গ) ভিজে ড়িাল (ঘ) মেষ মোষ এক সমান (ঙ) পাখীর কাছে ফুলের কাছে।

প্রাগৈতিহাসিক যুগের শিল্পকলার ইতিহাস

প্রাগৈতিহাসিক যুগ হতে আমরা মানুষের শিল্পচেতনার পরিচয় পাই। সে সময়ে মানুষ শিল্পকর্মের জন্ম দিয়েছিলো ঠিকই তবে তার ধরনটা ছিলো আলাদা। এ সময়ের শুরুতে মানুষ শিল্প সৃষ্টি করেছিলো প্রতিনিয়তঃ যুদ্ধ করে নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখবার জন্য। প্রগৈতিহাসিক যুগে মানুষকে জীবন ধারনের জন্য, খাদ্য সংগ্রহের জন্য জীবজন্তু শিকার করতে হতো। আর মূলতঃ এসব জীবজন্তুর ছবিই তারা এঁকেছে। আর এখান হতেই শুরু হয়েছিলো প্রগৈতিহাসিক শিল্পকলার ইতিহাস।

মানুষের আদিম বন্যদশা হতে সভ্যতার উত্তরণের পথটা ছিলো বন্ধুর। প্রতিকূল অবস্থা অতিক্রম করে তাকে পদে পদে নানা কষ্ট সহ্য করে এগুতে হতো নতুন কিছু উদ্ভাবন করতে।

পৃথিবীতে আগমনের পর হাজার বছর ধরে মানুষ শিকার করে জীবন ধারন করেছে। উৎপাদনের কৌশল রপ্ত করতে পারেনি বলে বুনো জন্তু শিকার করেছে পাথরের হাতিয়ারের সাহায্যে। এই সময়কে পাথর যুগ নামে অভিহিত করা হয়।

পাথরযুগকে প্রধানতঃ দুটি ভাগে ভাগ করা যায়-

১.প্যালিওলিথিক (পুরান প্রস্তর যুগ বা পুরাপলীয় যুগ)

২.নিওলিথিক (নব্য প্রস্তর যুগ)

এছাড়াও এ দুটি যুগের মধ্যবর্তী সময়ে তৃতীয় আরও একটি যুগের নাম দেয়া হয়েছে-

৩.মেসোলিথিক (মধ্যপলীয় যুগ)

প্যালিওলিথিক (পুরাপলীয় যুগ) : পুরা অর্থ প্রাচীন এবং উপল অর্থ পাথর আর এ দুটো শব্দের সমন্বয়ে হয়েছে পুরাপলীয় শব্দ। এ যুগে মানুষ তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে শিকারি কার্য়কলাপ চালিয়েছে পাথরের হাতিয়ারের মাধ্যমে।

তাই সমগ্রভাবে শিকারী যুগকে পুরালীয় যুগ বলা হয়। তবে সাধারনভাবে বলা চলে পুরাপলীয় যুগের শিকার ব্যবস্থাই ছিলো পৃথিবীর সব অঞ্চলের মানব সমাজের মূল ভিত্তি।

পুরাপলীয় যুগে মানুষ তাদের ধ্যান ধারনা ও জীবনের অভিজ্ঞতাকে চিত্রকলা ও ভাস্কর্যের মাধ্যমে রূপ দেয়ার চেষ্টা করেছে। এ যুগের শেষ পর্বে অর্থাৎ উচ্চ পুরাপলীয় যুগের গুহাবাসী শিকারী মানুষরা গুহার দেয়ালে ছবি এঁকেছে। আর এগুলোই হচ্ছে চিত্রকলার আদি নিদর্শন। তবে শিল্পকলার ইতিহাসে এই গুহাচিত্রগুলো আদি চিত্রকলার নিদর্শণ হিসেবে বিশেষ গুরুত¦ বহন করে।

এ যুগের মানুষের বাস্তবতা এবং তাদের আঁকা চিত্রের মধ্যে কোনো পার্থক্য নির্ণয়ে প্রয়াসী হয়নি। তার কাছে অঙ্কিত বস্তুটি ছিলো বাস্তব। বস্তু বা প্রাণীর অবয়ব সৃষ্টির পেছনে যে কারনটি কাজ করেছিলো তা হলো সে আকাঙ্খিত বস্তুটিকে পাওয়ার ইচ্ছা। এটিকে যাদুবিশ্বাস বলা হয়। নির্দিষ্ট কোনো পশুকে বধ করার ইচ্ছা বা কোনো শত্রুর প্রাণনাশের ইচ্ছা হতে এই যাদুবিশ্বাসের উদ্ভব। তবে একথা মনে করা হয় যে যাদুবিশ্বাস হতেই ধর্মের সৃষ্টি।

পুরানপ্রস্তর যুগে ভাস্কর্যের বেশ কিছু নিদর্শন মেলে। এগুলোর মধ্যে উৎপাদিকা শক্তির প্রতিকরূপে কিছু মাতৃকামূর্তি উল্লেখযোগ্য। সাধারনত এই সেই নগ্ন নারী মুর্তিগুলি অত্যন্ত স্থূলাঙ্গী, বক্ষ ও নিতম্ব বিশাল, মাংসল শিথিল, যাকে ইউরোপীয়রা সাধারন নাম দিয়েছে ভেনাস। গর্ভধারিনী এসব মাতৃমুর্তিগুলি গর্ভোন্মেষ প্রকাশের ক্ষেত্রে ছিলো আবেদনময়।

পুরাপলীয় যুগের বিখ্যাতএকটি মুর্তির নাম - ভেনাস অফ উইলেনডর্ফ ( খৃঃ ২৮০০০ - ২৩০০০ খৃঃ পূঃ লাইমস্টোন,৪’১/৪” উচ্চতা )

নিওলিথিক (নব্য প্রস্তর যুগ) : আনুমানিক আট হতে দশ হাজার বছর আগে মানুষ কৃষিকাজ আবিষ্কার করার পর তৎকালীন সমাজের আরো উন্নতি হয়। এ সময় মানুষ আরো উন্নত এবং মসৃন পাথরের হাতিয়ার ব্যবহার করতে শুরু করে। কৃষি আবিষ্কারের পর এই যুগকে নাম দেয়া হয়েছে নিওলিথিক (নব্যপ্রস্তর যুগ)।

নব্যপ্রস্তর যুগে মানুষ যাযাবর জীবন পরিত্যাগ করে কৃষিভিত্তিক স্থায়ী জীবনে অভ্যস্থ হতে শুরু করে। এ সময়ে মানুষ পশু শিকারের চাইতে পশু পালনের দিকে বেশী আগ্রহী হয়।

নব্যপ্রস্তর যুগেই আমরা প্রথম স্থাপত্য কর্মের নিদর্শন লক্ষ্য করি। এগুলোকে অবশ্য যথার্থ স্থাপত্য কর্ম বলা যায় না। তবে স্থাপত্যকর্মের আদিরূপ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। এ সময়ে নির্মিত স্থাপত্য কর্মের মধ্যে রয়েছে -

ডলমেন : নব্যপ্রস্তর যুগে নির্মিত প্রাচীন স্মৃতিস্তম্ভের উদাহরন। এটির নির্মানশৈলীতে রয়েছে সমাধির চারপাশে কতগুলো পাথর রাখা হতো। আর একখানা বড় পাথর দিয়ে উপরিভাগ ঢেকে দেয়া হতো। এই সমস্ত ডলমেন আবিষ্কৃত হয়েছে বিশাল এলাকা জুড়ে । ইংল্যান্ড, স্পেন প্রভৃতি অঞ্চলে এগুলি আবিষ্কৃত হয়েছে। এগুলির গুরুত্ব এজন্যই যে ডলমেনকে আমরা মানব সভ্যতার প্রাথমিক স্তরের স্থাপত্য হিসেবে চিহ্নিত করতে পারি। মানুষ এগুলির উপর ভিত্তি করেই নির্মান করেছিলো প্রথম স্থাপত্যের নিদর্শনাবলী।

স্টোনহেঞ্জ (খৃঃ পূঃ ২০০০ অব্দ) : নব্যপ্রস্তর যুগে আবিষ্কৃত আরো একটি স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শন স্টোনহেঞ্জ - যা ইংল্যান্ডে অবস্থিত। বিশাল বিশাল পাথর খন্ডকে অল্প ব্যবধানসহ দাঁড় করিয়ে তাদের মাথায় পাথর বসিয়ে দেয়া হতো। অধুনা পন্ডিতগন মনে করেন যে, এ সমস্ত স্টোনহেঞ্জ জ্যোতির্বিদ্যার কাজে ব্যবহৃত হতো।

পৃথিবীতে শিল্পচৈতন্যের উদ্ভব হয়েছে এভাবে আদিযুগ হতেই তা সম্মোহনের জন্যই হোক আর উৎসবের স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্যই হোক। জীবনকে স্পর্শ করেই শিল্পের সৃষ্টি। জীবনের প্রাত্যাহিকতা আনন্দিত রাখার জন্যই বিকাশ এবং ক্রমাগত শিল্পরীতির পরিবর্তন।

মানুষের বিবর্তনের ইতিহাস

আজকের পৃথিবীতে যে মানুষ বাস করছে এ জাতের মানুষের আবির্ভাব পৃথিবীতে ঘটেছিলো চল্লিশ হতে পঞ্চাশ হাজার বছর আগে। তার আগের অন্য এক অসম্পূর্ণ মানুষ হতে বিবর্তনের মাধ্যমে আধুনিক মানুষের উদ্ভব হয়েছিলো এবং তা ছিলো এক দীর্ঘকাল ব্যাপি প্রক্রিয়া।

মানুষের ইতিহাস বলতে তার রূপান্তরের, তার প্রগতিশীল বিকাশের বিবরনকেই বোঝায়। ক্রমবিকাশের ধারাবাহিকতায় মানুষ প্রথমে বন্যদশা ও পরে বর্বরদশা অতিক্রম করেছে, তারপর ঘটেছে সভ্যতার সূত্রপাত।

মানুষের এই বিবর্তনকে কয়েকটি পর্যায়ে ভাগ করা যায় :

১.প্রাইমেট

২.অষ্ট্রালোপিথেকাস

৩.খাড়া মানুষ

৪.নিয়ান্ডার্থাল মানুষ

৫.হোমো স্যাপিয়েন বা বুদ্ধিমান মানুষ

প্রাইমেট : প্রায় ৪-৫ কোটি বছর আগে এক জাতের স্তন্যপায়ী প্রাণী গাছে বাস করার ফলে ঐ পরিবেশের উপযোগী কতগুলো গুন অর্জন করেছিলো যা ভ’মিচর প্রাণীদের পক্ষে লাভ করা সম্ভব হয়নি। এ জাতের প্রাণীদের বলা হয় প্রাইমেট। গাছের ডালে বাস করার ফলে প্রাইমেটদের মাংসপেশী, ইন্দ্রিয় ও স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশ ঘটেছে। পরিবেশ হতে সহায়তা পাওয়ার ফলে প্রাইমেটরা কালক্রমে বড় মগজের অধিকারী হয়েছে। অতীতকালে প্রাইমেটদের একটি শাখা হতে বিবর্তনের মাধ্যমে ক্রমে ক্রমে মানুষের উৎপত্তি হয়েছে।

অষ্ট্রালোপিথেকাস : পরবর্তীতে উন্নততর এক প্রাইমেটের ফসিল পাওয়া যায় দক্ষিন আফ্রিকায়। এদের নাম দেয়া হয়েছে অষ্ট্রালোপিথেকাস। শব্দটির অর্থ দক্ষিনের নরবানর। কিন্তু আসলে এরা নরবানর ছিলো না। এদের দাঁত ছিলো ছোট আর কোমরের হাড়, হাত, পা, চোয়াল ইত্যাদি ছিলো প্রায় মানুষের মতো। তবে তার মস্তিষ্কের আয়তন ছিলো আধুনিক মানুষের প্রায় অর্ধেক।

খাড়া মানুষ : তাঞ্জানিয়ার হ্রদের পাড়ের আধা-মানুষদেরও বিবর্তন ঘটতে থাকে এবং আট-দশ লক্ষ বছর আগে আফ্রিকাতেই আরেক নতুন ধরনের মানুষের উৎপত্তি ঘটে। এদের নাম খাড়া মানুষ। এরা খাড়া হয়ে চলতে পারতো। এ মানুষের সময়ে তার আশেপাশে ছিলো আশ্চর্য সব জš-জানোয়ার। আর এ পরিবেশে বেচে থাকার জন্য মানুষকে আরো বেশী চালাক, চতুর ও দক্ষ শিকারী হতে হয়েছে। এদের হাতিয়ার ছিলো উন্নত ধরনের। আর এদের মগজও ছিলো বড়। খাড়া মানুষদের থুতনি বা কপাল বলতে কিছু ছিলো না, এদের ভুরুর খাজ ছিলো গভীর আর চোয়াল ছিলো বেশ বড়। দাঁত ও হাত-পা গুলো ছিলো মানুষের মতই।

নিয়ান্ডারথাল মানুষ : জামৃানীর নিয়ান্ডারথাল নামক স্থানে এক জাতের মানুষের কঙ্কালের সন্ধান পাওয়া গেছে। এই জায়গার নামানুসারে এ জাতের মানুষের নাম দেয়া হয়েছে নিয়ান্ডারথাল মানুষ।

নিয়ান্ডারথাল মানুষ ছিলো দৈহিক শক্তির অধিকারী এবং দক্ষ শিকারী। আগুন এবং হাতিয়ার তারা আয়ত্ত্ব করেছিলো। এ জাতের মানুষ বহু রকমের পাথরের হাতিয়ার তৈরী করতে পারতো। এরা মৃত মানুষের কবর দিতো। মানুষের ইতিহাসে এটা এক নতুন ঘটনা।

হোমো স্যাপিয়ান : চল্লিশ হতে পঞ্চাশ হাজার বছর আগে ইউরোপ এক নতুন ধরনের শিকারী মানুষের আবির্ভাব হয়। এদের কপাল ছিলো চওড়া, ভুরু মসৃন এরাই আধুনিক মানুষ। বর্তমান পৃথিবীতে শুধুমাত্র এ জাতের মানুষই আছে। এ আধুনিক মানুষের নাম দেয়া হয়েছে হোমো-স্যাপিয়েন।

মানুষ তার উৎপত্তির লগ্নে নিজেদের চেষ্টায় অর্থাৎ নিজেদের সামাজিক কার্যকলাপ দ্বারা দৈহিক বিবর্তন ঘটিয়ে আধুনিক সুসম্পূর্ন মানুষের উদ্ভব ঘটিয়েছে।

মেসোপটেমিয়ান আর্ট

মেসোপটেমিয়া একটি গ্রীক শব্দ। এর অর্থ দুই নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চল। এই দুই নদী বলতে টাইগ্রিস এবং ইউফ্রেটিসকে বোঝানো হয়েছে।

প্রাচীন সভ্যতার দিক হতে মিশরের পর মেসোপটেমিয়ার নাম করা যায়। তবে মিশর এবং মেসোপটেমিয়া সভ্যতা সমসাময়িক বলে ধারনা করা হয়। এ সভ্যতাকে আগে ব্যবিলনীয় বা ব্যবিলনীয় আসিরীয় নামে আখ্যায়িত করা হতো। মেসোপটেমিয়ার উত্তরাংশের নাম আসিরিয়া ও দক্ষিনাংশের নাম ব্যবিলনীয়া। ব্যবিলনিয়ার দুটি অংশ - দক্ষিনে সুমের ও উত্তরে আক্কাদ। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল হতে মানুষ এখানে এসে আবাস গড়ে তুলেছিলো। নব্যপ্রস্তর যুগের যাযাবর মানুষ আশ্রয়ের সন্ধানে এখানে এসে উপস্থিত হয়। সুমেরীয় ব্যবিলনীয় কাসাইট, আসিরীয়, ক্যলিডীয় প্রভৃতি জাতির অবদানে দীর্ঘকাল এ সভ্যতা সমৃদ্ধ হয়েছিলো। তাই সামগ্রিকভাবে এ সভ্যতাকে মেসোপটেমিয়া সভ্যতা বলাই অধিক যুক্তিযুক্ত।

মেসোপটেমিয়ায় প্রথমে যারা সভ্যতার গোড়াপত্তন করে তারা সুমের জাতি। সুমের জাতি কয়েকটি নগরীর গোড়াপত্তন করে। সুমেরের পরে আসে আক্কাদ জাতি। আক্কাইদ জাতির পর আমেরাইট জাতির আবির্ভাব ঘটে। আমেরাইট জাতির বিখ্যাত সম্রাট ছিলেন হাম্বুরাবি। তার রাজধানীর নাম ছিলো ব্যবিলন। আমেরাইটের পরে মেসোপটেমিয়ায় আগমন করে আসিরীয় জাতি।

মেসোপটেমিয়ায় জাতিসত্ত্বার গোড়াপত্তন : মেসোপটেমিয়ার পলিমাটি পড়া টাইগ্রিস এবং ইউফ্রেটিস নদী বিধৌত অঞ্চলই ছিলো খুব উর্বর। এ অঞ্চলে খাদ্যের প্রাচুর্য যাযাবর গোষ্ঠীর স্থিতিশীলতা এনে দেয়। ক্রমে জনসংখ্যাও বেড়ে যেতে থাকে। এখানকার আবহাওয়া সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলবার সহায়ক ছিলো। এ অঞ্চলের মানুষ মৃত্যু পরবর্তী জীবন নিয়ে বিশেষ ভাবেনি। তারা বুঝতো পার্থিব জীবনের সুখ আর আনন্দ। তারা যুদ্ধ ও শিকার করতে ভালোবাসতো। মেসোপটেমিয়ায় তাই শিকার ও যুদ্ধের প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষ্যনীয়।

সুমেরীয় শিল্পকলা : মেসোপটেমিয়ায় প্রথমেই যারা সভ্যতার গোড়াপত্তন করে, তারা সুমের জাতি। টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস এই দুটি নদী বেষ্টিত সুমের ছিলো কাদামাটির অঞ্চল। সুরক্ষিত শহর নির্মানে তারা ছিলো দক্ষ।

সুমেরিয়ান সংস্কৃতির একটি বিরাট বিষয় হলো জিগুরাট। অর্ম মন্দিররূপে জিগুরাতের অবস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চতুষ্কোন ভিতই এর প্রধান বৈশিষ্ট্য। প্রথম জিগুরাত নির্মিত হয়েছিলো উড় নামক শহরে। এটি সাদা মন্দির নামে খ্যাত। জিগুরাত নির্মানে সাধারনতঃ উপকরন হিসেবে রোদে পোড়া ইট ব্যবহৃত হত।

ভাস্কর্য নির্মানে সুমেরীয়রা দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। সুমেরীয়ান ভাস্কর্যের বৈশিষ্ট্য বড় বড় চোখ ও সিলিন্ডার আকৃতির দেহ পরিলক্ষিত হয়। খৃঃ পূঃ ৩৫০০ অব্দে মার্বেল পাথরে নির্মিত নারী মুর্তিটি অসম্ভব অভিব্যক্তিময়। এর ঠোঁট ও চিবুকের স্নিগ্ধ সৌন্দর্য চোখে পড়ে।

সুমেরীয়ান ভাস্কর্যের মধ্যে অন্যতম টেল-আসমারে আবুর মন্দির হতে উক্ত পুজারীদের কতগুলি মুর্তি। মুর্তিগুলির সবকটি উপাসনার ভঙ্গিতে দন্ডায়মান। এগুলি ঘাঘরা সদৃশ পোষাক পরিহিত। পুরুষ মুর্তির লম্বা ও কুঞ্চিত চুল ও দাড়ি সম্পূর্ণ কামানো।

আক্কাদীয় শিল্পকলা : দক্ষিন মেসোপটেময়ায় উরুক যুগের প্রথম দিকে সুমেরীয়রা আসে। সেই সময় বা তারও পূর্ব হতে টাইগ্রিস নদীর উচ্চ অববাহিকা অঞ্চলে সেমেটিক জাতির মানুষের বাস ছিলো যারা কালক্রমে আক্কাদীয় সম্রজ্যের প্রতিষ্ঠা করে। রাজা সারগন ছিলেন এই সম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। বিভিন্ন ভাস্কর্য হতে আক্কাদীয়দের আকৃতি সম্বন্ধে ধারনা করা যায়। তাদের মুখে সাধারনতঃ দাঁড়ি ও মাথার চুল ঘাড় পর্যন্ত লম্বা ছিলো।

আক্কাদিয় যুগের স্থাপত্য সম্বন্ধে খুব বেশী তথ্য আবিষ্কৃত না হলেও বহু ভাস্কর্যের নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। ভাস্কর্যগুলো সাধারনতঃ ব্রোঞ্জ ও পাথর দিয়ে তৈরী হতো যা ছিলো খুবই উন্নত। ভাস্কর্যগুলোর রূপ ছিলো পার্থিব।

খৃঃ পূঃ ২২০০ অব্দে নির্মিত আক্কাদীয় শাসকের ব্রোঞ্জ মুর্তিটি এ সময়ের শিল্পকলার একটি উল্লেখযোগ্য নিদর্শন। এর মুখের অভিব্যক্তিতে ছিলো আতœপ্রত্যয় ও পৌরুষদীপ্ত ভাবের প্রকাশ। এর মুখে ছিলো লম্বা দাঁত, চুল ঘাড়ের কাছে বাঁধা, চোখের গর্তে পাথর বসানো।

মার্গনের পুত্র নরমইসনের বীরত্ব কাহিনী বর্ণিত পাথরের একটি খন্ড আক্কাদীয় শিল্পের বিশিষ্ট উদাহরন (ভিক্টরিস টেল অফ নরম সিন ফ্রম সুসু, ২২০০খৃঃ পূঃ, পিঙ্ক, স্যান্ডস্টোন). এই খন্ডটি প্রায় ৭৫ ফুট উঁচু। এর গায়ে যুদ্ধ দৃশ্য উৎকীর্ণ। এতে রাজা নারামসিন তীর ধনুক হাতে পাহাড়ে উঠছেন সৈন্যদল নিয়ে। রাজাকে এখানে বড় করে দেখানো হয়েছে যা মিশরীয় শিল্পকলার অনুরূপ।

নিও সুমেরিয়ান শিল্পকলা : উত্তর পূর্ব দিক হতে আগত গুটি নামে এক বর্বর জাতির আক্রমনে আক্কাদীয় সাম্রাজ্যের পতন হয়। এ জাতির একজন শাসকের নাম ছিলো গুতিয়া। তার অসংখ্য ভাস্কর্য নির্মিত হয়েছিলো। এগুলোর বেশীর ভাগই দাড়ানো বা উপষ্টি অবস্থায়।

খৃঃ পূঃ ২১০০ অব্দে উপবিষ্ট অবস্থায় রাজা গুতিয়ার একটি ভাস্কর্য পাওওয়া যায় যা কঠিন ডিওরাইট পাথরে তৈরী। এতে রাজাকে একজন পূজারীরূপে দেখানো হয়েছে।

ব্যাবিলনীয় শিল্পকলা : সুমেরীয়দের পতনের পর আমেরাইট জাতি সুমের ও আক্কাদ জয় করে ব্যাবিলনীয় সভ্যতা গড়ে তোলেন। আমেরাইটদের নিজের সংস্কৃতি বিশেষ উন্নত ছিলো না, তারা মেসোপটেমিয়ার সম্রাজ্য পতন করে সুমেরীয়দের সভ্যতা সংস্কৃতিকেই গ্রহন করেছিলো। খৃঃ পূঃ ১৭৯২ - ১৭৫০ অব্দের মধ্যে ব্যবিলনের রাজা হাম্বুরাবি গোটা মেসোপটেমিয়াকেই ব্যবিলনের এককেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থার অধীনে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। তার সাম্রাজ্য বিরাট ছিলো।

আসিরিয় শিল্পকলা : টাইগ্রিস নদীর উচ্চ ববাহিকা অঞ্চলে বহু প্রাচীনকাল হতে একটি জাতি বাস করতো। তাদের প্রধান দেবতা ছিলো অসুর। অসুর দেবতার নামানুসারে সেই জাতি আসিরিয় নামে পরিচিত।

মেসোপটেমীয় অন্যান্য নির্মাণের মতো আসেরীয়রাও নির্মানের উপকরন হিসেবে কাদামাটির ইট ব্যবহার করতো। এ সময়ের অধিকাংশ ভাস্কর্যই ছিলো রিলিফ ভাস্কর্য। এ সময়ের ভাস্কর্যগুলোতে হিংস্রভাব প্রকাশ পেয়েছে। মানুষের সমস্ত সুকোমল বৃত্তিকে নির্মাতিত করে আসিরীয় সম্রাটগন রাক্ষুসে বা রক্তলোলুপ ভাবটিকে তীব্রভাবে প্রকাশ করার জন্য যেন শিল্পীদের নিযুক্ত করেছিলেন। ভাস্কর্যগুলোর অভিব্যক্তিতে কঠোর ও অনমনীয় ভাব। এসব ভাস্কর্যের অভিব্যক্তিতে প্রকাশ পেয়েছে উদ্ধত প্রকৃতির শাসকের ক্ষমাহীন বা নির্মম ভাব।

আসিরীয়রা ছিলো মহাপরাক্রান্ত এবং রণকৌশলে নিপুন। আসিরীয় সম্রাটগন যুদ্ধক্ষেত্র এবং শিকারের কাহিনীকে তাদের কলাকৌশল এবং বীরত্বের কাহিনীকে প্রাসাদের গায়ে ভাস্কর্য ও চিত্রকলার মাধ্যমে রূপদিতে শিল্পীদের নির্দেশ দেন। তাই যুদ্ধক্ষেত্র এবং শিকারের দৃশ্যপট আসিরীয় শিল্পের মুল উপজীব্য।

আসিরীয়ান ভাস্কর্যের অন্যতম নিদর্শন মেলে খৃঃ পূঃ ৭২০ অব্দে। এ সময়ে নির্মিত ভাস্কর্য লামাস্সু তে অদ্ভুত আকৃতি লক্ষ্যনীয়। এর মুখমন্ডল মানুষের মতো এবং দেহকানেডর আকার সিংহের মতো। পিঠের উপরে ঈগলের পাখাযুক্ত।

“ডাইং লায়নস” নামক ভাস্কর্যটিতে বানবিদ্ধ মরোম্মুখ একটি সিংহী অঙ্কিত হয়েছে। এর তুলনা বিশ্বের শিল্পভান্ডারে দুর্লভ। তিনটি বান সিংহীর পৃষ্ঠদেশ ভেদ করে চলে গিয়েছে। তবু সে দেহেরে সমস্তভার ন্যস্ত করে সম্মুখে অগ্রসর হওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করছে। এখানে আহত সিংহীর বাঁচার জন্য চোখে ফুটে উঠেছে তার অসহায়ত্ব।