Monday 5 July 2010

যোগাযোগ, গণসংযোগ ও সামাজিক আন্দোলনে শিল্প :

সমাজে শিল্প ও শিল্পীর রয়েছে প্রত্যক্ষ ভূমিকা। সমাজের এমন কোনো অংশ বা বিষয় নেই যোনে শিল্পীর এই প্রত্যক্ষ ভূমিকা বা অবস্থান অবর্তমান। সমাজের একজন হিসেবে শিল্পীর যেমন সামাজিক দায় দায়িত্ব আছে, তেমনি আছে শিল্পী হিসেবে সামাজিক মূল্যবোধ ও উন্নয়নে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখবার বিশেষ প্রয়োজনীয়তা। সমাজ কাঠামো বা সমাজ ব্যবস্থা অনুসারে একেক সমাজে শিল্পীর এই দায়িত্ব একেক রকম হতে পারে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে সকল সমাজেই শিল্প ও শিল্পীর সাধারণ কিছু ভূমিকা প্রত্যক্ষ করা যায়। যার প্রয়োগের প্রতিফলন সমাজের চরিত্রে প্রকৃষ্টরূপে পরিলক্ষিত হয়। তবে এছাড়াও সমাজের সর্বত্র শিল্পের যে প্রয়োগ তার প্রভাব সমাজে বসবাসকারী প্রতিটি মানুষের জীবনেই কমবেশী প্রতীয়মান।

সমাজে শিল্প ও তার প্রভাবের বিষয়টিকে আলোচনার সুবিধার্থে দুটি প্রধান ভাগে ভাগ করা যায়। এগুলি নিম্নরূপ -

· প্রথম ভাগের আলোচ্য বিষয় যোগাযোগ ও গণসংযোগে শিল্প -

এ অংশের আলোচনায় যোগাযোগ ও গণসংযোগে বাণিজ্যিক এবং সুকুমারকলা বা চারুশিল্পের প্রয়োগ ও সমাজে তার প্রভাব প্রভৃতি বিষয় স্থান পাবে।

· দ্বিতীয় ভাগের আলোচ্য বিষয় বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনে শিল্প -

এ অংশে বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনে শিল্পকলার ভূমিকা, তার প্রভাবে আন্দোলনে উদ্বুদ্ধকরণ ও আন্দোলন পরবর্তীকালে তার স্মরণে সৃষ্ট শিল্পকর্ম বিষয়ক আলোচনা স্থান লাভ করবে।

গণসংযোগে শিল্পকলার ভূমিকা ও তার প্রভাব অতিব্যপক। দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি মূহুর্তে আমরা কোনো কিছু পড়ে, শুনে বা দেখে শিখছি, জ্ঞান লাভ করছি ও তার আলোকে জীবন পরিচালিত করছি। এই শেখার রয়েছে নানা প্রচলিত মাধ্যম। আমাদের পঞ্চইন্দ্রিয় এতে নানাভাবে কাজ করে চলেছে। প্রাচীনকাল হতে মানুষের সাথে মানুষের সংযোগ ও ভাবের আদান প্রদানের ক্ষেত্রে বিভিন্ন দর্শন ও বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের মাধ্যমে। একদিকে যেমন চিত্র, ভাস্কর্য, সঙ্গীত, নাটক, নৃত্য, কাব্য, সাহিত্য ইত্যাদি বিষয়গুলি শিল্প চর্চার ক্ষেত্র হিসেবে বিকাশ লাভ করেছে, তেমনি পাশাপাশি এসকল ভাব প্রকাশের ভাষাকে গণসংযোগের ক্ষেত্রে প্রাচীনকাল হতেই নানা পরিকল্পিত উপায়ে ব্যবহার করা হয়ে আসছে।

আধুনিক মনোজ্ঞিানীদের গবেষণায় একটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ও বিপ্লবাত্মক আবিষ্কার হচ্ছে, প্রচলিত অন্যান্য যে কোনো মাধ্যমের তুলনায় দৃশ্যমান মাধ্যম বা ভিজ্যুয়াল মিডিয়া মানুষের মনের উপর সর্বাপেক্ষা ছাপ ফেলতে সক্ষম। লক্ষ্যণীয় যে আধুনিককালে যেখানে গণসংযোগের বিষয়টি রয়েছে সেখানে চিত্রভাষা বা শিল্পভাষার প্রয়োগ প্রায় অবশ্যম্ভাবীরূপে পরিলক্ষিত হয়। উদাহরণ হিসেবে শিক্ষার নিম্নতম পর্যায় হতে উচ্চতম গবেষণার ক্ষেত্র অবধি চিত্রভাষার রয়েছে ব্যপক প্রয়োগ। এছাড়া পণ্যের বিজ্ঞাপন হতে শুরু করে যে কোনো বিষয়ে জনমত সৃষ্টি বা প্রচারে রয়েছে চিত্রভাষার অনন্য প্রয়োগ - তা সে অঙ্কিত চিত্র হোক বা ফটোগ্রাফি হোক। আর তার সাথে প্রায়সই যুক্ত হয় লেখনী - যা আধুনিককালে গ্রাফিক ডিজাইন নামক শিল্পকলা হিসেবে স্বীকৃত।

সভ্যতার আদিমতম পর্বে অস্তিত্ব রক্ষা, শিকার ও যাদু বিশ্বাসের কারণে যে চিত্রভাষার জন্ম, তা আজ যোগাযোগ ও ভাবের প্রকাশের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ ভাষা বা মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। আজ আর একথা বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, শিল্প কেবল শিল্পীর আবেগ অনুভূতির প্রকাশক মাত্র। বরং তা মেসেজকে কার্যকরীভাবে প্রকাশের রীতি হিসেবে বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করছে। আবার তার ব্যপক ব্যবহারে মাধ্যমে নান্দনিক রুচিবোধের সৃষ্টি হচ্ছে ও প্রসার ঘটছে।

আধুনিককালে কেবল চিত্র বা শিল্প নয় সেই সঙ্গে লেখনীও ( রিটেন মেসেজ ) চিত্রভাষার অন্তর্গত। অবশ্য সুপরিকল্পিতভাবে প্রয়োগের উপরই এর সাফল্য নির্ভরশীল। একালে চিত্রভাষা অর্থ ‘কম্বিনেশন অফ আর্ট এন্ড টেকনোলজি’, যার সাথে প্রতিনিয়ত আমাদের পরিচয় ঘটছে। ফলে আমাদের চারপাশে সর্বত্রই এরব্যপক উপস্থিতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। দৈনিক সংবাদপত্র হতে শুরু করে পাঠ্য পুস্তক, ম্যাগাজিন, পথ চলতি পোস্টার, হোর্ডিং, ব্যানার, ফেস্টুন, বভিন্ন ডিসপ্লে, ফটোগ্রাফ, ফিল্ম, টেলিভিশন, সব কিছুতেই চিত্রভাষা তথা শিল্পের প্রয়োগ ও তার প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। সুতরাং গণসংযোগের ক্ষেত্রে আধুনিককালে শিল্পের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য একটি বিষয়ে পরিণত হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সমাজে শিল্পের প্রভাব ‍:

মানুষ তার নিজের তাগিদেই সমাজ গড়ে তুলেছে। সে ও সমাজ, এই সন্ধির মধ্যেই তার চলমান জীবন বা আরেক জীবন, যা তার সূক্ষ্ম অনভূতিতে প্রবাহিত। মানুষের এই জীবন বোধের বিভিন্ন দিক প্রকাশিত হয়েছে বিচিত্র সব কল্পনায়। আদিম যুগ হতেই মানুষের কল্পনার প্রকাশ ঘটেছে শিল্পরীতিতে। মানুষ বেঁচে থাকার তাগিদেই শিল্পকে গ্রহন করেছিলো তার সংগ্রামের হাতিয়ার রূপে। যদিও এ ছিলো এক ভিন্নতর কৌশলগত হাতিয়ার। সেখানে শিল্পীর ব্যক্তিত্ব সমাজ সাধারনের উর্দ্ধে বিশেষভাবে পরিলক্ষিত। শিল্পী সমাজের অঙ্গ, আবার তার বিশেষত্বের কারনেই সমাজের বা দৈনেন্দিন জীবনের স্থূল দিকের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই।

আধুনিক সমাজ বা তার শিল্পকলা হঠাৎ করে এই স্তরে উপনীত হয়নি। এই স্তরে আসার আগে তাকে আরো অনেকগুলি যুগ পারহয়ে আসতে হয়েছে। সেই পারহয়ে আসা যুগগুলির প্রথমেই প্রত্ন মানব আপন অনুভূতির স্বাক্ষর রেখেছে অন্ধকার গুহার দেয়ালে ছবি এঁকে। সেখান হতে মানুষ স্তরে স্তরে নিজের অমার্জিত ভাব ও ভাষাকে মার্জিত ও সুসংবদ্ধ করে তুলেছে।

সমাজে শিল্পকলার প্রভাব প্রাগৈতিহাসিককাল হতেই পরিলক্ষিত হয়। এক অর্থে শিল্প সমাজাশ্রয়ী। আবার অন্য অর্থে শিল্পীর ভাবাবেগ বর্জিত অনধ্যান সমাজের গতি ভঙ্গীমার নির্দেশক। আদিম সমাজ ও আধুনিক সমাজের মধ্যবর্তীকালীন সময় প্রবাহে সময় ও ব্যক্তির সম্পর্কের অসংখ্য বিভিন্নতা দেখা যায়। সামাজিক মূল্যবোধের সাথে সাথে বদলে যায় শিল্পধারা - এর বিষয়বস্তু, গতি - প্রকৃতি ও উপস্থাপনের রীতি।

শিল্পী সমাজ ছাড়া নয়, আবার পুরোপুরি সামাজিক ক্রিয়াকল্পের কারিগরও নয়। শিল্পীর কাজ ব্যবহারিক তাগিদে প্রকাশের প্রয়োজনীয় কর্মতৎপরতা অপেক্ষা অনেক গভীরে নিহিত - সেখানে সেই ব্যক্তি-শিল্পীর সমাজের বন্ধন আধুনিককালে এক বিচিত্র ও বিশেষ সমস্যা। তথাপি আধুনিককালেও শিল্পকলা সমাজ উন্নয়নে যথেষ্ট ভূমিকা রেখে চলেছে। শিল্প ও শিল্পী বিশেষের কারণে সমাজে রয়েছে শিল্পের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব।

যেকালে রাজন্যবর্গ বা প্রতাপশালীরা অর্থনৈতিক কারনে শিল্পের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন, সেকালে শিল্পীও সমাজের রীতিনীতিকে তথাকথিত নৈতিক চেতনার আওতায় রূপ দিতে বাধ্য ছিলো। যার জ্ঞান আমরা ইতিহাস হতে লাভ করি। পাশ্চাত্যের ক্ল্যাসিক বা ধ্রুপদী শিল্প যদিও শিল্পীর তথা তৎকালীন সমাজের মানসিকতার বহির্মুখী স্বাধীন চিন্তার ফসল, তথাপি সেকালে ধর্মের প্রচন্ড কর্মকান্ড শিল্পের মানদন্ড হিসেবেই সমাজে নিজস্ব ভূমিকা গ্রহন করেছিলো। যা মেনে নিয়েই সৃষ্টি হয়েছিলো সেকালের শিল্পকলার। ধর্মের ক্ষেত্রে যার রয়েছে বিশেষ অবস্থান ও ধর্মাশ্রয়ী সমাজে তার ছিলো বিশেষ প্রভাব। সেতুলনায় আভিজাত্য বিলাসী রোমান বা গ্রীক শিল্প চাতুর্য ছিলো ব্যক্তিত্ব বিকাশকারী। একই কথা ভারতীয় উপমহাদেশের শিল্পকলার ক্ষেত্রেও সমভাবে প্রযোজ্য। পরবর্তীকালে সমাজতান্ত্রিক বিশ্বে শিল্পকলা একটি ভিন্ন রূপ লাভে সমর্থ হয়, তথাপি সেক্ষেত্রেও শিল্প ছিলো কিছু সামাজিক নিয়ন্ত্রণের বেড়াজালে আবদ্ধ। শিল্প বা শিল্পী সত্যিকার অর্থে স্বাধীন ছিলোনা। সুতরাং সামাজিক উন্নয়নে তার ভূমিকা থাকা সত্ত্বেও তা সম্পূর্ণরূপে শিল্পীর ইচ্ছায় সৃষ্ট নাও হয়ে থাকতে পারে। সে তুলনায় আধুনিক বিমূর্ত শিল্পের শিল্পী অনেকটা মুক্ত, স্বাধীনভাবে নিজের আবেগের স্ফুরণ ঘটাতে পারছেন তার শিল্পকর্মে। আর তখনই প্রশ্ন জাগে এই বিমুর্ত শিল্প সমাজের কোনো কাজে আসে কিনা ? আর যদি আসে তবে তা কিভাবে ?

আমরা বিমুর্ত শিল্পকে কেবলমাত্র নিরস বুদ্ধির খেলা হিসেবে গণ্য করতে পারিনা বা অপ্রয়োজনীয় কোনো মানব মনের প্রতিধ্বনী বলাযায়না তাকে। সমাজ ও শিল্প পরস্পরের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত বিধায় ব্যক্তি-শিল্পীর বিষয়টিও এখানে সামাজিক দৃষ্টিকোন হতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বুদ্ধিদীপ্ত বিমুর্ত শিল্পকলা যতদিন ব্যক্তিত্বকে স্বীকার করে নিয়েছে, ততোদিনই বিমুর্ত শিল্পকলা অনন্য সাধারণ হয়ে উঠেছিলো। সামাজিক এই বোধ নিঃসন্দেহে সমাজে শিল্পের এক বিশিষ্ট প্রভাব।

একজন শিল্পীর কাজ অত্যন্ত সচেতন, মননশীল এক প্রতিক্রিয়া যার শেষে একটি শিল্পকর্ম আত্ম প্রকাশ করে বিনির্মিত বাস্তবতা হিসেবে - মোটেই কোনো উন্মত্ত অনুপ্রেরণায় সৃষ্ট বিষয় হিসেবে নয়।

শিল্পী হওয়ার জন্য রীতিনীতি, প্রথা, কৌশলগত দক্ষতা সকল কিছুর আয়ত্বের সাথে সাথে শিল্পীকে তাঁর আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করে সমাজের উপযুক্ত করে উপস্থাপন করতে হবে। তবেই সে শিল্প সক্ষম হবে সমাজে স্থায়ী ছাপ ফেলতে।

টানা পোড়েন বা দ্বান্দ্বিক বিরোধ শিল্পে সহজাত; বাস্তবের সুতীব্র অভিজ্ঞতা হতেই শুধু শিল্পের উদ্ভব হয়না, এটি অবশ্যই বিনির্মিতও হয়, বিষয়গত বাস্তবতার মধ্যে দিয়ে রূপ লাভ করে। শিল্প হচ্ছে ব্যক্তির সমগ্রের সাথে একীভূত হওয়ার অপরিহার্য উপায়। এটি তার সংঘবদ্ধ হওয়ার, অভিজ্ঞতা ও ধারনা বিনিময়ের অসীম সামর্থকে প্রতিফলিত করে।

শিল্পের যদি সমাজে আবশ্যকতা না থাকতো তবে তা সমাজ হতে তিরোহিত হতো এক সময়। চিত্রকর মন্ড্রিয়ান শিল্পের সম্ভাব্য ‘অন্তর্ধান’ - এর কথা বলেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, বাস্তবতা ক্রমবর্ধমান হারে শিল্পকে স্থানচ্যুত করবে। সারগতভাবে শিল্প হলো একটি ভারসম্য অবস্থার প্রতিকল্প, বর্তমানে বাস্তব জগতে যে ভারসাম্য অবস্থাটির ঘাটতি রয়েছে। ‘জীবনের অধিকতর ভারসাম্য অর্জনের সাথে সাথে শিল্প অন্তর্হিত হবে’।

জীবনের ‘প্রতিকল্প’ হিসেবে শিল্প পারিপার্শিক জগতের সাথে মানুষকে একটি ভারসাম্যবস্থায় স্থাপনের উপায় হিসেবে শিল্পের এই ধারনার মধ্যে শিল্পের প্রকৃতি ও প্রয়োজনীয়তার আংশিক স্বীকৃতি বিধৃত রয়েছে। আবার যেহেতু পারিপার্শিক জগৎ ও মানুষের মধ্যে স্থায়ী ও পরিপূর্ণ ভারসাম্য অতি উন্নত সমাজেও আশা করা যায় না, তাই এই ধারণাটি ইঙ্গিত করে যে, অতীতেই শুধু শিল্প প্রয়োজনীয় ছিলো তা নয়, যে কোনো সময়ই এর প্রয়োজনীয়তা থাকবে। সে অর্থে শিল্পের একটি প্রাথমিক করণীয়ও রয়েছে। তবে সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে সেই করণীয়টিও বদলে যায়।

সকল শিল্পই সময়ের শর্তাধীন ও একটি নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক অবস্থা হতে উদ্বুত ধারনা, আকাঙ্খা, চাহিদা ও প্রত্যাশার সাথে যতোটা সঙ্গতি বিধান করে, মানবতাকে সেই পরিমান প্রতিনিধিত্ব করে বা উপস্থাপন করে। কিন্তু একই সময় শিল্প কালের সীমাবদ্ধতা ছাড়িয়ে যায়,েঐতিহাসিক সীমাবদ্ধতার মধ্যে কালোত্তীর্ণ মানবতার একটি পর্যায়কেও সৃষ্টি করে। শ্রেণী সঙগ্রামের সমগ্র কাল জুড়ে সামাজিক উত্থান ও সহিংস পরিবর্তনের যুগ সত্ত্বেও ধারাবাহিক পরিবর্তনের অগ্রগতির গুরুত্বকে খাটো করে দেখা কোনোক্রমেই উচিত নয়। একইভাবে কালসাপেক্ষে শিল্পেও মানবতার অপরিবর্তনীয় বৈশিষ্ট্য ধাবিত হয়।

সমাজ, ধর্ম ও শিল্পকলা ‍:

দলবদ্ধভাবে বসবাসরত প্রাইমেট জাতীয় প্রাণী হতে ক্রমবিবর্তনের ধারায় পরিপূর্ণ মানবে রূপান্তরের কাল হতেই গোত্রের স্বার্থে মানুষ কিছু নিয়মনীতি মেনে চলতে শুরু করে, যার ফলশ্রুতিতে সৃষ্ট হয় মানব সমাজ বা সমাজ ব্যবস্থা। এই পরিপূর্ণ রূপান্তরের কাল হতেই মানব সমাজে শিল্পের অস্তিত্বের প্রয়োজনীয়তা ও তার উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়। সৃষ্টির তাগিদ মানব প্রকৃতির অঙ্গ। লেখনী আবিষ্কারের অনেক পূর্বেই মানুষ তাই অঙ্কন ও খোদাই শিল্প সৃষ্টিতে সক্ষম হয়েছিলো।

মানব সৃষ্টির সূচনা লগ্ন হতে আজ পর্যন্ত শিল্পকলা প্রায় একই ধরনের সামাজিক উদ্দেশ্য সাধনে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। শিল্পের প্রয়োজন সাধারণভাবে মানুষের সন্তুষ্টি সাধন - এই সন্তুষ্টি যেমন ব্যক্তি জীবনের জন্য প্রযোজ্য তেমনি সামগ্রিক সমাজের জন্যও। শিল্প যেমন কোনো কিছুর প্রদর্শনের জন্য ব্যবহৃত হয়, তেমনি বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতার জন্যও ব্যবহৃত হয়ে থাকে। আবার শিল্প আমাদের বস্তুগত চাহিদা যেমন ব্যবহার্য বস্তু সামগ্রী বা বাসস্থানের প্রয়োজনেও ব্যবহৃত হয়ে আসছে আদিকাল হতে অদ্যবধি।

দৃশ্যমান শিল্পকলা ( ভিজ্যুয়াল আর্ট ) - র বলিষ্ঠতম ্রয়োগগুলির অন্যতম আমাদের ভাব প্রকাশ ও গণসংযোগের ক্ষেত্র - যার মাধ্যমে আমরা আমাদের মনের গহীনে সৃষ্ট ভাব ও আমাদের ধারনার প্রকাশ ঘটিয়ে তা অন্যের নিকট বোধগম্য করে তুলতে সক্ষম হই। যার প্রয়োগ দেয়ালে ঝোলানো ছবি হতে শুরু করে দৈনন্দিন ব্যবহার্য বস্তুসামগ্রীসহ সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।

অনেক বিশেষজ্ঞের মতে প্রাগৈতিহাসিক যুগের শিল্পকর্মগুলি ছিলো শিকার ফলপ্রসু করার নিমিত্তে আয়োজিতো আচার অনুষ্ঠানের অংশ বিশেষ - যা শিকারে সহজে সফলকাম হওয়ার একটি প্রকৃষ্ট উপায়। আবার কারো কারো মতে এই শিল্পকর্মগুলির সৃষ্টি হয়েছিলো শিকারে সাফল্যের স্মারক হিসেবে ( যদিও প্রথমটির পক্ষেই পক্ষপাতিত্ব অধিক )।

প্রাগৈতিহাসিক মানব সমাজে যেহেতু ধর্মের উদ্ভব হয়নি, তাই সেখানে ধর্মীয় কারনে সৃষ্ট শিল্পকলার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়না। তবে সে সময় ধর্মের স্থান দখল করেছিলো যাদু বিশ্বাস। তাই প্রাগৈতিহাসিক মানব সমাজে যাদু বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে শিল্পকর্মের সৃষ্টি সর্বত্র পরিলক্ষিত হয়।

প্রাগৈতিহাসিক মানব সমাজে যাদু বিশ্বাসের কারনেই সকল শিল্পকর্মের সৃষ্টি হয়েছিলো ( উদাহরণ : গুহাচিত্র, মাতৃকা মূর্তি, মেগালিথস প্রভৃতি )।

ধর্ম বলতে আধুনিক কালে মানব সমাজে আমরা যে ধরনের বিশ্বাসকে বুঝি, প্রাগৈতিহাসিক মানব সমাজে তার অস্তিত্ব না থাকার কারনে শিল্পকলার সৃষ্টি স্বাভাবিক কারনেই সেসময় আশা করা যায়না। কিন্তু প্রাচীন মিশরীয় সমাজের প্রতিটি অংশেই ছিলো ধর্মের প্রত্যক্ষ প্রভাব। সেখানে পুরোহিতদের সহায়তায় শাসক বা ফারাওরা ছিলেন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী এবং দেবতার মতোই পুজোনীয়। মিশরীয়রা মৃত্যু পরবর্তী জীবনে বিশ্বাসী ছিলো, তাই তারা পূনর্জবিনের জন্য মৃতদেহ সংরক্ষণ করতো - যা মমি নামে পরিচিত। একই উদ্দেশ্যে ফারাওদের সমাধি বা পিরামিডের দেয়ালগাত্রে তারা এঁকে রাখতো তাদের জীবনের বিভিন্ন ঘটনা ও ধর্মগাঁথা। প্রাচীন মিশরীয় সমাজে ধর্মের প্রভাব এতোই ব্যপক যে তাদের শিল্পকলা প্রতিটি আঙ্গিক থেকেই পুরোপুরি নিয়ন্ত্রিত হয়েছিলো কঠোর ধর্মযি অনুশাসনের শৃঙ্খলে ( উদাহরণ : প্রাচীন মিশরীয় চিত্রকলা, ভাস্কর্য, স্থাপত্য ইত্যাদি )।

প্রাচীন মিশরীয় শিল্পকলা সকল অর্থেই ছিলো দ্বিমাত্রিক -

· চিত্রকলা - সার্ফেস ও উপস্থাপনা

ধর্ম ও ফারাও

· ভাস্কর্য - সম্মুখবর্তীতা

রিলিফ

ধর্ম ও ফারাও

· স্থাপত্য - মন্যুমেন্টালিটি

ধর্ম ও ফারাও

সুতরাং এটি সুস্পষ্টরূপে প্রতিয়মান যে প্রাচীন মিশরীয় সমাজের সকল কিছুই ধর্মকে ঘিরে আবর্তীত হতো, তাই সেসময়ের মিশরীয় শিল্পকলা ছিলো ধর্মের অনুজাত অনুষঙ্গ বিশেষ।

মেসোপটেমীয়দের জীবনেও ধর্মের ছিলো বিশিষ্ট স্থান। তবে তাদের ধর্মবোধ ছিলো মূলতঃ ইহলৌকিক জীবনের উন্নতি সাধনের নিমিত্তে। অনুমান করা হয় মৃত্যু পরবর্তী জীবন সম্পর্কে তাদের ধারনা ছিলো - মৃত্যুর পরে আত্মা কিছুকাল পরকালে অবস্থান করে চিরতরে বিলীন হয়ে যায়। তাই তাদের সমাজে ধর্মীয় আচারাদি ছিলো জাগতিক উন্নয়ন কামনা কেন্দ্রিক। পুরোহিতদের কড়া ধর্মীয় অনুশাসনে নিয়ন্ত্রিত হয়ে পরিচালিত হতো প্রাচীন মেসোপটেমীয় সমাজ ( আর শাসকরাই হতেন সেখানে প্রধান পুরোহিত )। ধর্মীয় অনুশাসনে নিয়ন্ত্রিত মেসোপটেমীয় সমাজের মশল্পকলাও তাই ধর্ম কেন্দ্রিক ছিলো। যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে তাদের স্থাপত্য শিল্পের অন্যতম নিদর্শন জিগুরাত সমূহ। কিংবা প্রার্থনারত বিভিন্ন ভঙ্গীর সম্রাটের মূর্তি, যেমন গুডিয়া।

মেসোপটেমীয় সমাজের ধর্ম বিশ্বাস সম্পর্কে যেহেতু খুব বেশী ধারনা পওেয়া যায়না, তাই তাদের প্রথম দিকের ভাস্কর্যে ব্যবহৃত বৃহদাকৃতি চোখ কোনো ধর্মজাত নাকি সম্মোহন জাতীয় কোনো প্রকার যাদু বিশ্বাসজাত তা বলা দূস্কর। তবে মেসোপটেমীয় সমাজে ধর্মীয় বিশ্বাসজাত বিপদ হতে রক্ষাকারী বৃষ বা ষাঁড়ের উপস্থিতি অসংখ্য শিল্পকর্মে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পরিলক্ষিত হয়। যা হতে ধারনা করা যায় মেসোপটেমীয় শিল্পকলায় ধর্মের প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিলো। তবে এটিও প্রতীয়মান হয় যে তাদের সমাজ বা শিল্পকলা মিশরীয়দের মতো ততটা কঠোর ধর্মযি অনুশাসনে নিয়ন্ত্রিত ছিলো না। ফলে সেখানে অসংখ্য ধর্মনিরপেক্ষ শিল্পের উপস্থিতিও পরিলক্ষিত হয়।

Sunday 4 July 2010

আর্ট ইন দি সোশাল কন্টেক্স্ট

সামাজিক জীব হিসেবে বিভিন্ন সমাজের, গোত্রের বা অঞ্চলের মানুষকে যে সকল নিয়ম নীতি মেনে চলতে হয় সেগুলি সমাজ, গোত্র বা অঞ্চল ভেদে বিশ্বের বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন বিধায় একেক মানব গোষ্ঠির রীতিনীতি, জীবনধারা একেক রকম হতে দেখা যায়।

মানব সমাজের নীতি নির্ধারণে যেমন রয়েছে আঞ্চলিক বিষয়াদির প্রভাব তেমনি রয়েছে সাংস্কৃকি প্রভাব, রাষ্ট্র-কাঠামো, রাজনৈতিক প্রভাব ইত্যাদির প্রত্যক্ষ প্রতিফলন। একইভাবে প্রতিটি সমাজের উপরে শিল্পকলার প্রভাবও বিদ্যমান।

সমাজের উপর শিল্পকলার যেমন প্রভাব রয়েছে তেমনি সমাজে বসবাসকারী হিসেবে শিল্পীরও রয়েছে সমাজে বিশেষ দায়িত্ব। এই দায়িত্ব পালনের মাধ্যমেই শিল্পী সমাজে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিতে পরিণত হয়ে ওঠেন। সামাজিক প্রেক্ষিতে শিল্পের অবস্থা ও অবস্থান বিষয়ে আলোচনায় তাই সমাজ ও শিল্প বলতে কি বুঝায় সে বিষয়ে পরিষ্কার ধারনা থাকা আবশ্যক।

মানুষ একত্রে বসবাসের জন্য নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম নীতি মেনে চলে বা চলতে বাধ্য হয়। এই নিয়ম নীতি মেনে একত্রে বসবাসের জন্য যে সংগঠন বা সংঘ তাকে এক কথায় সমাজ বলা যায়। এক্ষেত্রে সমাজ বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন দৃষ্টিকোন হতে সমাজের সঙ্গা নিরুপনের চেষ্টা করেছেন। ঠিক একই ভাবে শিল্পেরও সঙ্গা প্রদানের চেষ্টা করেছেন। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে শিল্প বলতে আর্টকে বোঝানো হয়েছে ইন্ডাস্ট্রিকে নয়। শিল্পকলা মূলতঃ একটি অনুভূতিজতি বিষয়, সেকারনে এর নির্দিষ্ট কোনো সঙ্গা নেই। বিভিন্ন দার্শনিক ও শিল্পবোদ্ধ‍া তাই তাদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গী বা দৃষ্টিকোন হতে এ বিষয়ে মতামত ব্যক্ত করেছেন।

বিখ্যাত সমালোচক হার্বাট রীড তার “মিনিং অফ আর্ট ” গ্রন্থে শিল্প কি বলতে গিয়ে প্রথমেই উল্লেখ করেছেন, “শিল্প বলতে আমরা সাধারনত ‘প্ল্যাস্টিক’ বা ‘ভিজ্যুয়াল’ শিল্পকে বুঝি”। কিন্তু বাস্তবে শিল্প হিসেবে ‘ভিজ্যুয়াল আর্টে - এর পাশাপাশি সাহিত্য, সঙ্গীত প্রভৃতিকেও বোঝানো হয় বলে তিনি উল্লেখ করেছেন।

তিনি শোপেনহাওয়ারের বক্তব্য তুলে ধরে বলেন যে, শোপেনহাওয়ারই প্রথম বলেন সকল শিল্পই সঙ্গীতের নিয়ম মেনে গড়ে ওঠে। তার মতে সঙ্গীতই বিশুদ্ধতম শিল্প।

হার্বাট রীডের মতে শিল্পের কাজ হচ্ছে আনন্দদায়ক অনুভূতির প্রকাশ ঘটানো। এই আনন্দদায়ক অনুভূতি হচ্ছে আমাদের সৌন্দর্যবোধের জন্য পরিতৃপ্তি দায়ক। আর আমাদের সৌন্দর্যবোধের পরিতৃপ্তি তখনই সম্ভব যখন কোন বিষয় বা ছন্দ আমাদের বোধের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক স্থাপনে সক্ষম হয়।

শিল্পকলার কোনো ধরাবাঁধা সঙ্গা নেই এবং কোনো সঙ্গাই দীর্ঘস্থায়ী নয়। যেমন টলস্টয় মনে করতেন - ‍শিল্পকলা হবে মানুষের জন্য প্রয়োজনীয়, হবে নতুন সৃষ্টি, হবে সুখবোধ্য।

কিন্তু আজকের শিল্পকলা মানুষের জন্য সুখবোধ্য হবে বা প্রয়োজনীয় হবে এমন কথা কেউ জোর দিয়ে বলতে পারে না।

তাই নিউ ইয়র্কের ‘মিউজিয়াম অফ মডার্ণ আর্ট ’ - এর অ্যালফ্রেড বার মন্তব্য করেছেন, “শিল্পকলার সঙ্গা দেয়া বোকামী ছাড়া আর কিছুই নয়”।

লন্ডনের ‘টেট গ্যালারী’র প্রাক্তন পরিচালক স্যার জন রথেনস্টাইনের মতে “শিল্পীর ইচ্ছার উপর নির্ভর করে শিল্প”। অর্থাৎ শিল্পী তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী যে শৈল্পিক বিষয় বা বস্তু সৃষ্টি করবেন তাকে শিল্প বলা যেতে পারে। জর্জ সান্টায়ানা মনে করতেন যে শিল্পকলার কাজ হচ্ছে “মানুষকে আনন্দ দান করা”।

আবার রেনেসাঁ শিল্পকলার বিশেষজ্ঞ বার্নাড বেরেন্সন শিল্পকলাকে “জীবন উন্নয়নকারী” কর্ম বলে অভিহিত করেছেন।

সুজান লেঙ্গার শিল্পকলাকে একটি অনুভূতি বা ‘ফিলিং’য়ের ব্যাপার বলে মনে করেন।

যদিও বিভিন্ন মনিষী শিল্পকলাকে বিভিন্নভাবে উপস্থাপনের প্রয়াস পেয়েছেন, তবে একটি বিষয় সর্বসম্মতভাবে স্বীকৃত, সেটি হলো শিল্পকলা মূলতঃ একটি অভিব্যক্তি, শিল্পী ও দর্মকের মধ্যে একটি আত্মিক যোগাযোগের সেতু এবং সর্বোপরি একটি নতুন কিছুর নির্মাণ।

অবশ্য আধুনিক শিল্পকলার শিল্পী ও দর্শকের মধ্যে যোগাযোগের গুরুত্বও কিছুটা শিথিল হয়ে এসেছে ( কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেড়েছেও বটে )।

স্যার কেনেথ ক্লার্ক আধুনিক চিত্রকলার ৩টি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছেন ‍:-

১. এর বিশুদ্ধতম বিমূর্তরূপ

২. কমিউনিকেশন গুণ এবং

৩. চিত্রে বিজ্ঞানের বর্ধিত ব্যবহার।

উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলি কেবল চিত্রশিল্পে নয়, শিল্পকলার সকল শাখার জন্যই সমভাবে প্রযোজ্য এবং আধুনিক শিল্পকলা সবদেশেই কমবেশী উপরোক্ত গুণসমূহে সমৃদ্ধ।

‘দি সার্চ অফ বিউটি ইন মডার্ন আর্ট ’ -এ আলফ্রেড নিউমেয়ার বলেছেন “বারবার কোনো একটি শিল্পরূপের সামনে দাঁড়াতে দাঁড়াতে আমরা তাতে এতোখানি অভ্যস্ত হয়ে যেতে পারি যার ফলে ধীরে ধীরে শিল্পকলার প্রতি আমাদের সমগ্র ধারনাই বদলে যেতে পারে”। এর ফলশ্রুতিতে অনেক ক্ষেত্রে এমনও হয় যে, শিল্পকলাকে আমাদের কাছে বাস্তব এবং বাস্তবকে বা প্রকৃতিকে আমাদের কাছে শিল্পকলা বলে মনে হয়। এক্ষেত্রে শিল্প সম্পর্কে পিকাসোর একটি মন্তব্য উল্লেখ করা যেতে পারে, তিনি বলেছেন- “কেউ সূর্য আঁকেন হলুদ বৃত্ত দিয়ে, আবার কেউ হলুদ বৃত্ত এঁকে সূর্য নির্মাণ করেন”।

আলফ্রেড নিউমারের বক্তব্যের প্রেক্ষিতে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায় লন্ডনের ন্যাশনাল গ্যালারীতে রক্ষিত কুইনটিন মেসিসের অনুকরণে অজ্ঞাত শিল্পীর আঁকা “গ্রটেস্কিউ ওল্ড ওমেন” নামক চিত্রটি। যেখানে কুৎসিত দর্শন এক বৃদ্ধাকে উপস্থাপন করেছেন শিল্পী, কিন্তু গ্যালারীর কর্মচারীদের কারো কারো বক্তব্য এরূপ, ছবিটি দেখতে দেখতে তারা এমনই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন যে সেটি তাদের কাছে কুৎসিত দর্শনতো মনে হয়ইনা বরং মনে হয় ছবিটি ঐ স্থানে না থাকলে বিষয়টি বিসদৃশ হবে।

আবার শিল্পের গুনাবলী নির্ধারণে পিকাসোর বক্তব্যের প্রেক্ষিতে আমরা পিকাসোর আঁকা “ওলগা পিকাসো ইন এন আর্মচেয়ার” ও “ডোরা মার সিটিং” নামক চিত্র দু’খানির তুলনা করতে পারি।

পিকাসোর ছবি দু’খানির বিশ্লেষণ করলে বলা যায় শিল্প প্রকৃতির বাস্তব সম্মত প্রতিচ্ছবিই হবে এমন কোনো কথা নেই, বরং অনেক ভ্রান্ত এবং অস্বাভাবিক বিষয়াদিও সার্থক শিল্প নির্মাণে সক্ষম। এক্ষেত্রে বলা চলে শিল্প বা শিল্পীর লক্ষ্য হচ্ছে- “লাই দ্যাট টেল্স দি ট্রুথ” ফর সামথিং “রিয়েলার দ্যান রিয়েল”, যা শিল্পকে দর্শকের কাছে বোধগম্য করে তোলে।

শিল্পকলার ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করলে যে বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে তা হলো কেবলমাত্র ইউরোপেই নির্দিষ্ট কিছুকাল সময় প্রাকৃতিক বিষয়বস্তুর বাস্তবসম্মত উপস্থাপনের মাধ্যমে শিল্প সৃষ্টি হয়েছিলো।

প্লেটো তাঁর “দি রিপাবলিকে” বলেছেন শিল্পীর লক্ষ্য হবে তার সামনে দৃশ্যমান বস্তুর আয়নায় প্রতিফলনের মতো প্রতিচ্ছবি সৃষ্টি। প্লেটোর এই মতকে চূড়ান্ত ধরে নিয়েই গ্রীক, রোমান ও পরবর্তী রেনেসাঁ যুগের ইউরোপীয় শিল্পীরা শিল্প সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু এশিয়া, আফ্রিকা বা উপনিবেশ-পূর্ব আমেরিকায় প্রকৃতির পুঙ্খানুপুঙ্খ প্রতিচ্ছবি নির্মাণের প্রচেষ্টা অনেক কম পরিলক্ষিত হয়। শিল্পী বরং সেখানে তার শিল্পে বিষয়বস্তুগত অনুভূতি প্রকাশে অনেকবেশী সচেষ্ট।

এক শতাব্দিকাল পূর্বেও শিল্পকলা কাকে বলে এমন প্রশ্নের অবতারণা ছিলো অবান্তর, কারন শিল্প সম্বন্ধে সকলেরই একটা সাধারণ স্পষ্ট ধারণা ছিলো। কিন্তু বিংশ শতাব্দিতে এসে সেই ধারণা আমূল বদলে গেছে আধুনিক কালের একটি শিল্পকর্ম বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের ট্র্যাডিশনাল আর্টের অনেক কাছাকাছি যা গ্রীক, রোমান বা রেনেসাঁ যুগের ক্ল্যাসিকাল শিল্পের বিপরীতে অবস্থান করছে।

আবার আধুনিক শিল্পকলার প্রধান বৈশিষ্ট্য ‘জাতীয় বৈশিষ্ট্য’ নয়, ‘ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য’- একথা বিশ্বের যেকোনো জাতির শিল্পকলার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। ব্যক্তিগত স্টাইলের অন্বষণে শিল্পী ঠিক কিসের উপর ভর করবেন বলা শক্ত। কেউ অত্যন্ত ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে, কেউ স্থানীয় গণ-মানসকে, কেউ জাতীয় বা শিল্পকলার বৃহত্তর আঞ্চলিক ঐতিহ্যকে, কেউ আবার বিশ্ব সংস্কৃতিকে আশ্রয় করে নিজেকে প্রকাশ করেন। যিনি সত্যিকার প্রকিভাবান, যার সৃষ্টি সুগভীর, যার ইন্দ্রিয় সর্বদা সজাগ, তার ব্যক্তিত্ব স্বাভাবিকভাবেই গঠিত হবে বহু ঐতিহ্যের সংমিশ্রণে এবং তার শিল্পকর্ম যতোই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, স্থানীয় পরিবেশ বা শিল্প সংস্কৃতির দ্বারা সীমাবদ্ধ হোক তা মহৎ এবং বিশ্বজনীন শিল্পকলায় উন্নীত হবেই। সেই অর্থে পিকাসোর অবদান যেমন তেমনি বিমূর্ত কিবরিয়ার।

বাংলাদেশের উন্নতমানের আধুনিক বা সমকালীন শিল্পকলাকে আন্তর্জাতিক আধুনিক ধারার অন্তর্ভূক্ত করে নেয়াই শ্রেয়। ব্যক্তিগত স্বাতন্ত্রমন্ডিত শিল্পরূপ নির্মাণ আধুনিক শিল্পীর লক্ষ্য, বাংলাদেশের শিল্পীরও, তবু শিল্পীদের মধ্যে পারস্প‍ারিক যোগাযোগ, নৈকট্য এবং প্রভাবের ফলে গোষ্ঠীগত শিল্পরীতি জন্ম নেয় বলেই এখানকার শিল্পকলা আন্তর্জাতিক আধুনিক ধারার অন্তর্ভূক্ত হওয়া স্বত্ত্বেও স্ব স্ব ভাবে কিছুটা ভিন্নতর হয়ে পড়েছে।