Sunday 4 July 2010

আর্ট ইন দি সোশাল কন্টেক্স্ট

সামাজিক জীব হিসেবে বিভিন্ন সমাজের, গোত্রের বা অঞ্চলের মানুষকে যে সকল নিয়ম নীতি মেনে চলতে হয় সেগুলি সমাজ, গোত্র বা অঞ্চল ভেদে বিশ্বের বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন বিধায় একেক মানব গোষ্ঠির রীতিনীতি, জীবনধারা একেক রকম হতে দেখা যায়।

মানব সমাজের নীতি নির্ধারণে যেমন রয়েছে আঞ্চলিক বিষয়াদির প্রভাব তেমনি রয়েছে সাংস্কৃকি প্রভাব, রাষ্ট্র-কাঠামো, রাজনৈতিক প্রভাব ইত্যাদির প্রত্যক্ষ প্রতিফলন। একইভাবে প্রতিটি সমাজের উপরে শিল্পকলার প্রভাবও বিদ্যমান।

সমাজের উপর শিল্পকলার যেমন প্রভাব রয়েছে তেমনি সমাজে বসবাসকারী হিসেবে শিল্পীরও রয়েছে সমাজে বিশেষ দায়িত্ব। এই দায়িত্ব পালনের মাধ্যমেই শিল্পী সমাজে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিতে পরিণত হয়ে ওঠেন। সামাজিক প্রেক্ষিতে শিল্পের অবস্থা ও অবস্থান বিষয়ে আলোচনায় তাই সমাজ ও শিল্প বলতে কি বুঝায় সে বিষয়ে পরিষ্কার ধারনা থাকা আবশ্যক।

মানুষ একত্রে বসবাসের জন্য নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম নীতি মেনে চলে বা চলতে বাধ্য হয়। এই নিয়ম নীতি মেনে একত্রে বসবাসের জন্য যে সংগঠন বা সংঘ তাকে এক কথায় সমাজ বলা যায়। এক্ষেত্রে সমাজ বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন দৃষ্টিকোন হতে সমাজের সঙ্গা নিরুপনের চেষ্টা করেছেন। ঠিক একই ভাবে শিল্পেরও সঙ্গা প্রদানের চেষ্টা করেছেন। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে শিল্প বলতে আর্টকে বোঝানো হয়েছে ইন্ডাস্ট্রিকে নয়। শিল্পকলা মূলতঃ একটি অনুভূতিজতি বিষয়, সেকারনে এর নির্দিষ্ট কোনো সঙ্গা নেই। বিভিন্ন দার্শনিক ও শিল্পবোদ্ধ‍া তাই তাদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গী বা দৃষ্টিকোন হতে এ বিষয়ে মতামত ব্যক্ত করেছেন।

বিখ্যাত সমালোচক হার্বাট রীড তার “মিনিং অফ আর্ট ” গ্রন্থে শিল্প কি বলতে গিয়ে প্রথমেই উল্লেখ করেছেন, “শিল্প বলতে আমরা সাধারনত ‘প্ল্যাস্টিক’ বা ‘ভিজ্যুয়াল’ শিল্পকে বুঝি”। কিন্তু বাস্তবে শিল্প হিসেবে ‘ভিজ্যুয়াল আর্টে - এর পাশাপাশি সাহিত্য, সঙ্গীত প্রভৃতিকেও বোঝানো হয় বলে তিনি উল্লেখ করেছেন।

তিনি শোপেনহাওয়ারের বক্তব্য তুলে ধরে বলেন যে, শোপেনহাওয়ারই প্রথম বলেন সকল শিল্পই সঙ্গীতের নিয়ম মেনে গড়ে ওঠে। তার মতে সঙ্গীতই বিশুদ্ধতম শিল্প।

হার্বাট রীডের মতে শিল্পের কাজ হচ্ছে আনন্দদায়ক অনুভূতির প্রকাশ ঘটানো। এই আনন্দদায়ক অনুভূতি হচ্ছে আমাদের সৌন্দর্যবোধের জন্য পরিতৃপ্তি দায়ক। আর আমাদের সৌন্দর্যবোধের পরিতৃপ্তি তখনই সম্ভব যখন কোন বিষয় বা ছন্দ আমাদের বোধের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক স্থাপনে সক্ষম হয়।

শিল্পকলার কোনো ধরাবাঁধা সঙ্গা নেই এবং কোনো সঙ্গাই দীর্ঘস্থায়ী নয়। যেমন টলস্টয় মনে করতেন - ‍শিল্পকলা হবে মানুষের জন্য প্রয়োজনীয়, হবে নতুন সৃষ্টি, হবে সুখবোধ্য।

কিন্তু আজকের শিল্পকলা মানুষের জন্য সুখবোধ্য হবে বা প্রয়োজনীয় হবে এমন কথা কেউ জোর দিয়ে বলতে পারে না।

তাই নিউ ইয়র্কের ‘মিউজিয়াম অফ মডার্ণ আর্ট ’ - এর অ্যালফ্রেড বার মন্তব্য করেছেন, “শিল্পকলার সঙ্গা দেয়া বোকামী ছাড়া আর কিছুই নয়”।

লন্ডনের ‘টেট গ্যালারী’র প্রাক্তন পরিচালক স্যার জন রথেনস্টাইনের মতে “শিল্পীর ইচ্ছার উপর নির্ভর করে শিল্প”। অর্থাৎ শিল্পী তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী যে শৈল্পিক বিষয় বা বস্তু সৃষ্টি করবেন তাকে শিল্প বলা যেতে পারে। জর্জ সান্টায়ানা মনে করতেন যে শিল্পকলার কাজ হচ্ছে “মানুষকে আনন্দ দান করা”।

আবার রেনেসাঁ শিল্পকলার বিশেষজ্ঞ বার্নাড বেরেন্সন শিল্পকলাকে “জীবন উন্নয়নকারী” কর্ম বলে অভিহিত করেছেন।

সুজান লেঙ্গার শিল্পকলাকে একটি অনুভূতি বা ‘ফিলিং’য়ের ব্যাপার বলে মনে করেন।

যদিও বিভিন্ন মনিষী শিল্পকলাকে বিভিন্নভাবে উপস্থাপনের প্রয়াস পেয়েছেন, তবে একটি বিষয় সর্বসম্মতভাবে স্বীকৃত, সেটি হলো শিল্পকলা মূলতঃ একটি অভিব্যক্তি, শিল্পী ও দর্মকের মধ্যে একটি আত্মিক যোগাযোগের সেতু এবং সর্বোপরি একটি নতুন কিছুর নির্মাণ।

অবশ্য আধুনিক শিল্পকলার শিল্পী ও দর্শকের মধ্যে যোগাযোগের গুরুত্বও কিছুটা শিথিল হয়ে এসেছে ( কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেড়েছেও বটে )।

স্যার কেনেথ ক্লার্ক আধুনিক চিত্রকলার ৩টি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছেন ‍:-

১. এর বিশুদ্ধতম বিমূর্তরূপ

২. কমিউনিকেশন গুণ এবং

৩. চিত্রে বিজ্ঞানের বর্ধিত ব্যবহার।

উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলি কেবল চিত্রশিল্পে নয়, শিল্পকলার সকল শাখার জন্যই সমভাবে প্রযোজ্য এবং আধুনিক শিল্পকলা সবদেশেই কমবেশী উপরোক্ত গুণসমূহে সমৃদ্ধ।

‘দি সার্চ অফ বিউটি ইন মডার্ন আর্ট ’ -এ আলফ্রেড নিউমেয়ার বলেছেন “বারবার কোনো একটি শিল্পরূপের সামনে দাঁড়াতে দাঁড়াতে আমরা তাতে এতোখানি অভ্যস্ত হয়ে যেতে পারি যার ফলে ধীরে ধীরে শিল্পকলার প্রতি আমাদের সমগ্র ধারনাই বদলে যেতে পারে”। এর ফলশ্রুতিতে অনেক ক্ষেত্রে এমনও হয় যে, শিল্পকলাকে আমাদের কাছে বাস্তব এবং বাস্তবকে বা প্রকৃতিকে আমাদের কাছে শিল্পকলা বলে মনে হয়। এক্ষেত্রে শিল্প সম্পর্কে পিকাসোর একটি মন্তব্য উল্লেখ করা যেতে পারে, তিনি বলেছেন- “কেউ সূর্য আঁকেন হলুদ বৃত্ত দিয়ে, আবার কেউ হলুদ বৃত্ত এঁকে সূর্য নির্মাণ করেন”।

আলফ্রেড নিউমারের বক্তব্যের প্রেক্ষিতে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায় লন্ডনের ন্যাশনাল গ্যালারীতে রক্ষিত কুইনটিন মেসিসের অনুকরণে অজ্ঞাত শিল্পীর আঁকা “গ্রটেস্কিউ ওল্ড ওমেন” নামক চিত্রটি। যেখানে কুৎসিত দর্শন এক বৃদ্ধাকে উপস্থাপন করেছেন শিল্পী, কিন্তু গ্যালারীর কর্মচারীদের কারো কারো বক্তব্য এরূপ, ছবিটি দেখতে দেখতে তারা এমনই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন যে সেটি তাদের কাছে কুৎসিত দর্শনতো মনে হয়ইনা বরং মনে হয় ছবিটি ঐ স্থানে না থাকলে বিষয়টি বিসদৃশ হবে।

আবার শিল্পের গুনাবলী নির্ধারণে পিকাসোর বক্তব্যের প্রেক্ষিতে আমরা পিকাসোর আঁকা “ওলগা পিকাসো ইন এন আর্মচেয়ার” ও “ডোরা মার সিটিং” নামক চিত্র দু’খানির তুলনা করতে পারি।

পিকাসোর ছবি দু’খানির বিশ্লেষণ করলে বলা যায় শিল্প প্রকৃতির বাস্তব সম্মত প্রতিচ্ছবিই হবে এমন কোনো কথা নেই, বরং অনেক ভ্রান্ত এবং অস্বাভাবিক বিষয়াদিও সার্থক শিল্প নির্মাণে সক্ষম। এক্ষেত্রে বলা চলে শিল্প বা শিল্পীর লক্ষ্য হচ্ছে- “লাই দ্যাট টেল্স দি ট্রুথ” ফর সামথিং “রিয়েলার দ্যান রিয়েল”, যা শিল্পকে দর্শকের কাছে বোধগম্য করে তোলে।

শিল্পকলার ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করলে যে বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে তা হলো কেবলমাত্র ইউরোপেই নির্দিষ্ট কিছুকাল সময় প্রাকৃতিক বিষয়বস্তুর বাস্তবসম্মত উপস্থাপনের মাধ্যমে শিল্প সৃষ্টি হয়েছিলো।

প্লেটো তাঁর “দি রিপাবলিকে” বলেছেন শিল্পীর লক্ষ্য হবে তার সামনে দৃশ্যমান বস্তুর আয়নায় প্রতিফলনের মতো প্রতিচ্ছবি সৃষ্টি। প্লেটোর এই মতকে চূড়ান্ত ধরে নিয়েই গ্রীক, রোমান ও পরবর্তী রেনেসাঁ যুগের ইউরোপীয় শিল্পীরা শিল্প সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু এশিয়া, আফ্রিকা বা উপনিবেশ-পূর্ব আমেরিকায় প্রকৃতির পুঙ্খানুপুঙ্খ প্রতিচ্ছবি নির্মাণের প্রচেষ্টা অনেক কম পরিলক্ষিত হয়। শিল্পী বরং সেখানে তার শিল্পে বিষয়বস্তুগত অনুভূতি প্রকাশে অনেকবেশী সচেষ্ট।

এক শতাব্দিকাল পূর্বেও শিল্পকলা কাকে বলে এমন প্রশ্নের অবতারণা ছিলো অবান্তর, কারন শিল্প সম্বন্ধে সকলেরই একটা সাধারণ স্পষ্ট ধারণা ছিলো। কিন্তু বিংশ শতাব্দিতে এসে সেই ধারণা আমূল বদলে গেছে আধুনিক কালের একটি শিল্পকর্ম বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের ট্র্যাডিশনাল আর্টের অনেক কাছাকাছি যা গ্রীক, রোমান বা রেনেসাঁ যুগের ক্ল্যাসিকাল শিল্পের বিপরীতে অবস্থান করছে।

আবার আধুনিক শিল্পকলার প্রধান বৈশিষ্ট্য ‘জাতীয় বৈশিষ্ট্য’ নয়, ‘ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য’- একথা বিশ্বের যেকোনো জাতির শিল্পকলার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। ব্যক্তিগত স্টাইলের অন্বষণে শিল্পী ঠিক কিসের উপর ভর করবেন বলা শক্ত। কেউ অত্যন্ত ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে, কেউ স্থানীয় গণ-মানসকে, কেউ জাতীয় বা শিল্পকলার বৃহত্তর আঞ্চলিক ঐতিহ্যকে, কেউ আবার বিশ্ব সংস্কৃতিকে আশ্রয় করে নিজেকে প্রকাশ করেন। যিনি সত্যিকার প্রকিভাবান, যার সৃষ্টি সুগভীর, যার ইন্দ্রিয় সর্বদা সজাগ, তার ব্যক্তিত্ব স্বাভাবিকভাবেই গঠিত হবে বহু ঐতিহ্যের সংমিশ্রণে এবং তার শিল্পকর্ম যতোই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, স্থানীয় পরিবেশ বা শিল্প সংস্কৃতির দ্বারা সীমাবদ্ধ হোক তা মহৎ এবং বিশ্বজনীন শিল্পকলায় উন্নীত হবেই। সেই অর্থে পিকাসোর অবদান যেমন তেমনি বিমূর্ত কিবরিয়ার।

বাংলাদেশের উন্নতমানের আধুনিক বা সমকালীন শিল্পকলাকে আন্তর্জাতিক আধুনিক ধারার অন্তর্ভূক্ত করে নেয়াই শ্রেয়। ব্যক্তিগত স্বাতন্ত্রমন্ডিত শিল্পরূপ নির্মাণ আধুনিক শিল্পীর লক্ষ্য, বাংলাদেশের শিল্পীরও, তবু শিল্পীদের মধ্যে পারস্প‍ারিক যোগাযোগ, নৈকট্য এবং প্রভাবের ফলে গোষ্ঠীগত শিল্পরীতি জন্ম নেয় বলেই এখানকার শিল্পকলা আন্তর্জাতিক আধুনিক ধারার অন্তর্ভূক্ত হওয়া স্বত্ত্বেও স্ব স্ব ভাবে কিছুটা ভিন্নতর হয়ে পড়েছে।

No comments:

Post a Comment