Wednesday 2 December 2009

লোকজউত্‍সব, মেলা

লোকজীবনধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত লোকসমাজের প্রথা, অভ্যাস রেওয়াজ, সামাজিক রীতিনীতি (পঁংঃড়স) মূলতঃ অতিপ্রাকৃত শক্তি, দৈববাণী, জাদুবিদ্যা প্রভৃতি অন্ধ বিশ্বাস ও সংস্কৃতিসংশিস্নষ্ট৷ লোকসমাজের প্রথায়, অভ্যাসে তার স্ফ্থরণ ঘটে৷ ফলে (পঁংঃড়স) সামাজিক প্রথা, অভ্যাস, রেওয়াজের সঙ্গে (ংঁঢ়বত্‍ংঃরঃরড়হং) অন্ধ বিশ্বাসের একটা ঘনিষ্ট সম্পর্ক রয়েছে৷ অন্ধ বিশ্বাসের মতো সামাজিক প্রথাতেও লোকসংস্কৃতির বাকজাতীয় (াবত্‍নধষ) ও বস্তুজাতীয় (হড়হ াবত্‍নধষ) উপাদান বর্তমান৷ লোকসাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সুনির্দিষ্ট অবস্থায় তা প্রয়োগযোগ্য৷
মূলতঃ লোকজীবনে (ভড়ষশ ষরভব) কোন লোকসমাজের মানুষের ঐতিহ্যিক দিক লোকসাহিত্য, লোক সঙ্গীত, আচার- আচরণ, অনুষ্ঠান, বিশ্বাস এবং বস্তুজাতসংস্কৃতি-লোক কারম্নশিল্প৷ এ কারণে লোকজীবনের অনত্মর্ভূক্ত প্রথা (পঁংঃড়স) লোকসমাজের মানুষের গোষ্ঠীকেন্দ্রিক বার্ষিক আমোদের, আনন্দেও অনুষ্ঠান- উত্‍সবের গুরম্নত্ব সাংস্কৃতিক, জাতিতাত্তি্বক৷ বার্ষিক আমোদ ও আনন্দকেন্দ্রিক উত্‍সবের যে প্রথা রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম নবান্ন, নববর্ষ এবং পৌষউত্‍সব, মেলা৷ এছাড়া ধর্মীয় ঈদ, মহরম, বিভিন্ন পূজা, চৈত্র সংক্রানত্মি উপলৰে আয়োজিত উত্‍সব মেলা৷ এসব দিনে উত্‍সব, মেলা আয়োজনের ঐতিহ্যিক প্রথা আমাদের লোকজীবনের ঐতিহ্য৷ এভাবেই গ্রামীণ লোকজীবন ধারার অবিচ্ছেদ্য অংশ লোকমেলা৷ প্রতি বছর নানা পাল-পার্বণে ধর্মীয় উত্‍সবকে ঘিওে আয়োজিত লোকমেলার রয়েছে লোকজীবনের আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক গুরম্নত্ব৷ লোকজীবন ধারার পরিচায়ক বস্তুজাত সংস্কৃতির বস্তু-লোক ও কারম্নশিল্পের প্রসার, উত্‍কর্ষ, যোগাযোগ, বাজার ও সমন্বয়ের ৰেত্র লোক মেলা৷ উপলৰ্য হিসেবে কখনো ধর্মীয়, কখনো কৃষিভিত্তিক জীবনের আচার অনুষ্ঠানগত রূপের পরিসীমায় মেলা আয়োজন করা হয়৷ এভাবেই মেলা একটি ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে৷
এছাড়া আবহমানকাল হতে বাংলাদেশের স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামীণ লোকজীবনের সার্বিক উন্নয়নকে মেলায় তুলে ধরা, ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা হয়৷ সেই সঙ্গে লোকসমাজের সকল সত্মরের বয়সের মানুষের মধ্যাকার একটি বাসত্মব যোগাযোগ, যার মধ্যে অনত্মর্ভূক্ত রয়েছে আর্থ- সামাজিক-সাংস্কৃতিক দিক৷ ফলে মেলা হয়েছে আমাদের দেশের গ্রামের সাধারণ মানুষের আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের কেন্দ্র এবঙ আবালবৃদ্ধবনিতা সকলের অতি পরিচিত, প্রাণের, জীবনের আনন্দের ৰেত্র৷ এভাবে গ্রামের সাধারণ মানুষের সস্কৃতির লালন, রূপানত্মরের ৰেত্রই বলা চলে মেলাকে৷
বাংলাদেশের মেলা এদেশের মানুষের গোষ্ঠীগত চেতনার নানা প্রাচীন অনুষঙ্গ, চিত্র, বৈশিষ্ট্য, বৈশিষ্ট্যেও নানা দিকের অজানা তথ্য, তত্ত্ব আবিষ্কারের অশেষ ৰেত্র৷ মেলা ধর্মীয় বা ধর্মনিরপেৰ যে ধরনেরই হোক না কেনো গ্রামীণ পরিবেশের মানুষের দ্বারা গঠিত গোষ্ঠির আশা আকাক্সখা, উন্নয়ন, মেলার চরিত্রকে নিয়ন্ত্রণ কওে থাকে৷ অর্থাত্‍ লোকসমাজের চাহিদার উপর ভিত্তি করেই মেলার চালচিত্র,বৈশিষ্ট্য সৃজিত হয়ে থাকে৷ জীবনের প্রাত্যহিকতাকে পরিপূর্ণ করতে একদিকে কৃষি উপকরণ, অপরদিকে দৰ হাতের তৈরি বস্তু, দ্রব্য-লোক ও কারম্নশিল্পের বিনিময়, লেনদেন মেলার একটি বড় কার্য়ক্রম৷
আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রেৰিতে লোকজীবনে ব্যক্তি মানুষের অবস্থান, চলার পথে মেলা এবং সামগ্রিক অগ্রগতি ও উন্নয়নকে অবলোকন করার আনুষ্ঠানিক আয়োজন হচ্ছে লোকমেলা৷ লোকসংস্কৃতির সাংস্কৃতিক উপাদান, অবস্থা বস্তুজাতসংস্কৃতি- লোক ও কারম্নশিল্পের প্রসার ও আদান প্রদানের ৰেত্র লোকমেলা বাংলাদেশের মানুষের লোকজীবনধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত৷
বাংলাদেশের লোকজীবন এদেশের প্রাকৃতিক পরিবেশের বৈশিষ্ট্য ও সীমারেখায় সৃষ্ট কৃষিব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল৷ লোকজীবন ধারার এই প্রধান বৈশিষ্ট্য নিয়েই এদেশের লোকসংস্কৃতি, বস্তুজাতসংস্কৃতির গড়ন, রূপ নির্ধারিত হয়েছে৷ গ্রামীণ কৃষিজীবন ভিত্তিক, লোকজীবনধারার প্রয়োজনীয় বস্তুজাতসংস্কৃতির লোক ও কারম্নশিল্প এদেশের প্রাকৃতিক পরিবেশের সহজলভ্য উপাদান, কাঁচামাল, উপকরণে তৈরি৷ লোকজীবন ধারায মানুষের জন্ম হতে মৃতু্য পর্যনত্ম যা কিছু প্রয়োজনীয় বস্তু-বস্তুজাতসঙস্কৃতি-লোক ও কারম্নশিল্পের অনত্মর্ভ্থক্ত৷ এর শ্রেণীকরণ এভাবে হতে পারেঃ
১. কৃষি কাজের সরঞ্জাম ঃ লাঙ্গল, বাঁশের ঝুড়ি, ধানের গোলা, ধান চাল মাপার বাঁশের, বেতের কাঠা, বাঁশের, বেতের মাথাল, ঢেকি, কুলা, বাঁশের খালই, ধামা৷
২. গার্হস্থ্য জীবনের প্রয়োজনীয় জিনিস ঃ মাটির হাঁড়ি, পাতিল, কলসি, শানকি, বাটি, গামলা, চাবি, কাঠের চামচ, তালপাতার ও বাঁশের-বেতের পাখা, বাঁশের ঝুড়ি, কাঠের বাক্স, পাটের সিকা, শীতলপাটি, হোগলা, মাদুর, শতরঞ্জী, প্রদীপদানী৷
৩. বাসস্থানের জন্য ঃ মাটির, বাঁশের, বাঁশ-ছনের ঘর৷ বাঁশের বেড়া, বেলকি, দরমা, কাঠের দরজা, জানালা, চৌকাঠ৷
৪. বস্ত্র পরিচ্ছদ ঃ সুতিবস্ত্র, শাড়ী, লুঙ্গী, ধুতি, নকশী কাঁথা, গামছা, ফতুয়া৷ এবং উপজাতি ও আদিবাসীদের পোশাক, পরিচ্ছদ৷
৫. যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রয়োজনে ঃ নৌকা, গরম্নর গাড়ী, পাল্কী৷
৬. মানুষের সৌন্দর্যবোধ সংক্রানত্ম ঃ বাঁশের বাশী, ঢোল, কারম্নকার্যময় কাঠের, বাঁশের জিনিস, একতারা, দোতারা, বাদ্যযন্ত্র৷
৭. শিশুদের আনন্দ বিধান ঃ মাটির পুতুল, বাঁশের, কাঠের খেলনা, হাতী, ঘোড়া, পুতুল, গরম্নর গাড়ী৷
৮. ধর্মীয়, লোকজ বিশ্বাস ঃ মাটির কাঠের তৈরী প্রতিমা, মূর্তি, কাঠের মূর্তি, মাটির তৈরী লৰীসরা৷ পাটি-জায়নামাজ, কোরানের গিলাফ, পটচিত্র৷
৯. সাধারণ আসবাব ঃ জলচৌকি, কাঠের পিড়ি, কাঠের বাক্স, কাঠের তাক, বাঁশের, বেতের বাক্স, ঝুড়ি৷
১০. অঙ্গের সাজ সজ্জা ঃ লোক অলঙ্কার, পুতির মালা৷
বাংলাদেশের লোকজীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ লোকজউত্‍সব, মেলা এদেশের বস্তুজাত সংস্কৃতি-লোক কারম্নশিল্পের কেন্দ্র৷ এই ঐতিহ্য আমাদের সংস্কৃতির ঐতিহ্য৷ অর্থাত্‍ হাজার বছর ধরে বাংলাদেশের বস্তুজাত সংস্কৃতি লোক কারম্নশিল্পের বিক্রয় ও প্রসারের কেন্দ্র লোকজ উত্‍সব, মেলা৷ লোকজ উত্‍সব ও মেলা যেমন আমাদের সাংস্কৃতিক উপাদান এবং সেই সঙ্গে এক ধরনের সাংস্কৃতিক অবস্থাও বটে৷ বস্তুজাতসংস্কৃতি-লোককারম্নশিল্প আমাদের দেশের লোকজীবনধারা- সংস্কৃতির অবকাঠামো সৃষ্টির কাজটি কওে থাকে৷ সেই সঙ্গে লোকজীবনধারা-লোকসংস্কৃতির বাকজাতীয় সাংস্কৃতিক উপাদান-সংস্কৃতির উপরিকাঠামোকেও যুগপত্‍ ধারণ করে৷ জাতীয়সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, এর স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে বস্তুজাতসংস্কৃতির-বস্তু লোককারম্নশিল্পের মূল্য, গুরম্নত্ব অপরিসীম৷ বস্তুতঃ বস্তুজাতসংস্কৃতি লোককারম্নশিল্প লোকসমাজের মানুষের লোকজীবনধারা-লোক সংস্কৃতিকে ধারণ করে৷ এজন্য বস্তুজাতসংস্কৃতির বস্তু, লোককারম্নশিল্প জাতিতাত্তি্বক৷ এর বিশেস্নষণ ও মূল্যায়নের জন্য প্রথমে বস্তুজাতসংস্কৃতির অনত্মর্ভূক্ত বস্তু লোককারম্নশিল্পের অসংখ্য নমুনার দলিলীকরণ করা অপরিহার্য৷ আঞ্চলিক-স্থানিক, ও কালিক ব্যবধানে বহু বিচিত্র ধরনের অসংখ্য বস্তুজাতসংস্কৃতি-লোককারম্নশিল্প ক্রমাগত সাংস্কৃতিক রূপানত্মর প্রক্রিয়ায় রূপানত্মরিত হয়ে চলমান, অব্যাহত রয়েছে৷ বাংলাদেশের ঐতিহ্যের লোক জীবনধারায় আজ অবধি ক্রমপুঞ্জিত ভাবে রূপানত্মরিত ধারাবাহিক রূপকে বস্তুজাতসংস্কৃতির বস্তু, লোককারম্নশিল্প ধারণ কওে সচল, অব্যাহত রয়েছে৷
লোকজউত্‍সব ও মেলায় বস্তুজাতসংস্কৃতি-লোককারম্নশিল্পের উলিস্নখিত লোকজীবনধারাকেন্দ্রিক দৈনন্দিন ব্যবহার্য বহু বিচিত্র জিনিস কেনা বেচা, লেনদেন হয়ে থাকে৷ এই নিয়ম ও ধারাটিও আমাদের লোকসাংস্কৃতির ঐতিহ্যের প্রথা, রেওয়াজ এবং সংস্কার৷ আবহমান কাল হতে আজ অবধি আমাদেও দেশের ধর্মনিরপেৰ বা ধর্মীয় সকল উত্‍সব, মেলায় এক এবং অভিন্ন ঐতিহ্য অনুসৃত হচ্ছে৷ এবং লোকজউত্‍সব, মেলা আমাদের লোকসমাজের লোকজীবনধারার সাংস্কৃতিক পরিচয়বাহী বস্তুজাতসংস্কৃতি-লোককারম্নশিল্পের প্রদর্শন, প্রসার বাজারের আদর্শ কেন্দ্র৷ বাংলাদেশের লোকজীবনধারা-লোকসংস্কৃতির প্রবহমান ধারাটি এখনো এদেশের গ্রামের মানুষের অনুভব চেতনায়, জীবনযাপনে সক্রিয়৷ ফলে লোকজীবনধারা-লোকসংস্কৃতির তাগিদ, প্রথা, নিয়ম, রেওয়াজ লোকজউত্‍সব মেলাকে একটি সংস্কার হিসেবে আবহমান কাল হতে আজ অবধি আয়োজন করা হয়৷ লোকজউত্‍সব, মেলার এই আয়োজন ঐতিহ্যিক ধারার পাশাপাশি স্থানিক ও কালিক ব্যবধানে নবনব রূপে লোকজ উত্‍সব, মেলা আমাদেও জাতীয় সাংস্কৃতিক পরিন্ডলে রূপলাভ করে চলেছে৷

No comments:

Post a Comment