Wednesday 18 November 2009

গ্রীক ভাস্কর্য

শিল্পকলার ক্ষেত্রে গ্রীকরা প্রভূত উন্নতি সাধন করেছিলো। বিশেষতঃ ভাস্কর্য শিল্পে গ্রীকদের নৈপুন্যের যথার্থ পরিচয় পাওয়া যায়। আর গ্রীক ভাস্কর্যের উন্নতির কারণ হিসেবে বলা যেতে পারে মানুষের শারীরিক গঠন সম্পর্কে তাদের কৌতুহল। প্রদিকে গ্রীক ভাস্কর্যের বৈশিষ্ট্য ছিলো আদর্মবাদ এবং সুন্দর করে তৈরী করা। তবে পরবর্তীতে এ নীতির পরিবর্তন ঘটে এতে গঠিত, মখাভিব্যক্তি এবং মানবতাবাদ প্রকাশ পায়।

গ্রীক শিল্পের উত্তরন পর্বকে তিনটি সময়কালে ভাগ করা যায় - আর্কেইক, ক্লাসিকাল এবং হেলেনিস্টিক। এই তিনটি পর্বে গ্রীক ভাস্কর্যের চরিত্রগত পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়।

গ্রীক ভাস্কর্যে ধর্মের প্রভাব পড়েছিলো প্রবলভাবে। তবে গ্রীকরা তাদের দেবতাদের লালন করেছিলো অন্যভাবে। গ্রীক ভাস্কররা তাদের দেবদেবীর মূর্তির মধ্য দিয়ে মানুষের অন্তর্নিহিত সহজাত প্রবৃত্তিকে ফুটিয়ে তুলেছে। তাদের দেবতা ছিলো মানুষের মতই সাধারণ। অর্থাৎ তাদের শিল্পের মূল কথা হচ্ছে সবকিছু মানুষের জন্য এবং মানুষই সবকিছুর মাপকাঠি।

গ্রীক ভাস্কর্যের প্রাথমিক পর্বে এগুলোতে জ্যামিতিক প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। খৃঃ পূঃ অষ্টম শতাব্দীতে ব্রোঞ্জের তৈরী একজন যোদ্ধার ভাস্কর্যে ফিগারের সরলতা প্রকাশ পায়। তার বড় চোখ আর মুখমন্ডলের হাসির রেখা পরবর্তী সময়ে আর্কাইক স্মাইল নামে পরিচিত হয়। ভাস্কর্যটিতে শরীর আর মুখের অনুপাত সঠিকভাবে দেখা যায় না।

আর্কেইক পিরিয়ডে ভাস্কর্যগুলোতে মিশরীয় রীতির প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। দন্ডায়মান যুবক (ফুরস্) মূর্তিগুলোতে মিশরীয় শিল্পের প্রভাব রয়েছে। এসব মূর্তিগুলোর হাত সাধারণতঃ মুষ্ঠিবদ্ধ এবং বাম পা একধাপ এগিয়ে। কিন্তু মিশরীয় মূর্তির পরনে যে কাপড় ছিলো তা এখানে অনুপস্থিত, এগুলো সম্পূর্ণ নগ্ন। খৃঃ পূঃ ৬০০ অব্দে যুবকের মূর্তিটিতে (কওরোস ৬০০ খৃঃ পূঃ মার্বেল ৬’১/২” উচ্চতা) মিশরীয় প্রভাব লক্ষ্যনীয়। তবে এতে হাঁটু উরু ইত্যাদিতে ডিটেইল কাজ মিশরীয় ভাব ধারার বাইরে। পেশীর স্থাপনা যেন ভেতরকার শরীরতাত্ত্বিক বাস্তবতাকে প্রকাশ করছে।

খৃঃপূঃ ৫৩০ অব্দে নির্মিত একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার মুর্তিতে (মার্বেল পাথরের) শিল্পী শরীরতাত্ত্বিক কাঠামো প্রকাশের পাশাপাশি তার ব্যক্তিসত্তার অভিব্যক্তিকেও প্রকাশ করছে। এই যোদ্ধার নাম ছিলো ক্রোইসস। যুদ্ধে সে বীরের মতো প্রাণ দিয়েছিলো। আগের সব দেহের তুলনায় এটি আরো অধিকভাবে তার ব্যক্তি স্বাতন্ত্র বা ব্যক্তি চরিত্রকে প্রকাশ করছে।

পেপলসকোর নামে ভাস্কর্যটি (মার্বেল পাথরের ৪’ উচ্চতা) খৃঃ পূঃ ৫৩০ অব্দে নির্মিত। এতে মেসোপটেমীয় প্রভাব লক্ষ্যনীয়। এর চোখ মুখে নারী সৌন্দর্য্যরে অভিব্যক্তি প্রকাশ পেয়েছে।

প্রাচীন গ্রিক শিল্পীরা ভাস্কর্যে ড্রাপারীর বিন্যাসের ক্ষেত্রে নৈপুণ্যের পরিচয় দিয়েছে। খৃঃ পূঃ ৫১০ অব্দে নারীমুর্তিতে (কোর, মার্বেল পাথরের, ২১’১/২”) তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। এই ড্রাপারীর বিষয়টি নারী মুর্তিতে বেশী দেখা যায়।

পুরুষের মতো নারী মুর্তিকে তার ন্যুড করে তৈরী করতো না কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া। খৃঃ পূঃ ৫০০ অব্দের দিকে ক্রমে এইসব নগ্ন শরীর শরীরতাত্ত্বিক বাস্তবতা সুসংহত স্ট্রাকচার, সবকিছু গ্রিক শিল্পীদের হাতে পূর্ণতা পেলো। খৃঃ পূঃ ৪৮০ অব্দে “ক্রিটিয়স রয়” (মার্বেল পাথরের ৩৪” উচ্চতা) মুর্তিটিতে এই বৈশিষ্ট্যের প্রকাশ পেয়েছে। দেহের অবস্থান খুব সামঞ্জস্যপূর্ণ রেখে, সামনে পেছনের পায়ের উপর দেহের ভারকে স্বাভাবিকভাবে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। মানবদেহের পেশীগুলোর জীবন্ত রেখাই প্রকট হয়ে উঠেছে এখানে। এভাবেই গ্রিকভাস্কর্য গতিহীনতাকে অতিক্রম করেছিলো।

খৃঃ পূঃ ৪৩৮ - ৪৩২ অব্দে ডাইওনাইসস এর মুর্তিটি আর্কেইক ভিগারেটিভ হতে মুক্ত হয়ে এসেছে (মার্বেল পাথরের)

“থ্রি গডেসেস ফ্রম দ্যা পার্থেনন” ভাস্কর্যটিতে (৪৩৮ - ৪৩২) ফিগারের আবদ্ধতা যেন একে অন্যের পরিপূরক আর তার সঙ্গে ড্রাপারীর অপূর্ব কাজ। এই কাপড়ের ভাঁজে ভাঁজে মিশে আছে যেন জবিনের স্পন্দন। এটি শিল্পী ফিদিয়াসের আশ্চর্য এক সৃষ্টি। এতে আছে আলো ছায়ার অপূর্ব কাজ আর গতিময়তা। এটি পার্থেনন মন্দিরের গায়ে উৎকীর্ণ করা ভাস্কর্য।

শিল্পী ফিদিয়াসের করা আরো একটি বিখ্যাত ভাস্কর্যের মধ্যে “হেব অব দ্য প্রসেশন” (প্রসেশন অফ এলডারস এন্ড মেইডেনস, পার্থেনন ৪৪৭ - ৪৩৮ খৃঃ পূঃ মার্বেল পাথরের, ৩’৬” উচ্চতা) একটি সাধারন ঘটনা নিয়ে রৈী এটি। এটিও পার্থেননের দেয়ালে উৎকীর্ণ। এটি একটি শোভাযাত্রার দৃশ্য যাতে কুমারী মেয়েরা দেবী এথেনার উদ্দেশ্যে যাত্রা করছে। এতে কাপড়ের ভাঁজের সূক্ষœ কাজ আজো আমাদের মুগ্ধ করে। একটি সাধারন বিষয় যেন শিল্পী নান্দনিকরূপে প্রকাশ করেছেন এতে।

শিল্পী ফিদিয়াসের তৈরী বিখ্যাত ভাস্কর্যের মধ্যে পার্থেনন মন্দিরের দেবী এথনার মুর্তি। মুর্তিটি ছিলো কাঠের তৈরী। এটি মূল্যবান পাথর ও ধাতু দিয়ে সজ্জিত ছিলো। এর উপরিভাগ হাতির দাঁত দ্বারা আবৃত ছিলো। এখানে দেবী এথেনাকে মানুষ হিসেবে তৈরী করা হয়েছে। তার ক্ষমতা যাদুবিদ্যায় নয় বরং সৌন্দর্য্যে

ভাস্কর মাইরন ছিলেন ফিদিয়াসের সমসাময়িক। তার “ডিস্কাস থ্রোয়ার” মুর্তিটিতে একজন খেলোয়ারের রূপ প্রকাশ পেয়েছে। তার “ডিস্কোবোলাস” জগদ্বিখ্যাত। এখানে একজন খেলোয়ারের ডিস্কাস নিক্ষেপের পূর্ব মুহূর্তের ভঙ্গি দেখানো হয়েছে। মানুষের গতিময়তার প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার এক চূড়ান্ত অভিব্যক্তিকে ভাস্কর স্থায়ী করেছেন পৃবিীর শিল্প ইতিহাসে। খৃঃ পূঃ ৪০০ অব্দের দ্বিতীয়ার্ধের সবচেয়ে বিখ্যাত ভাস্কর ছিলেন লিসিপস। তিনি সম্রাট আলেকজান্ডারের ভাস্কর ছিলেন। খৃঃ পূঃ ৩৩০ অব্দে এপোক্সিমেনোস ভাস্কর্যে (৬’৯” উচ্চতা) তিনি একজন তরুন ক্রিড়াবিদকে নির্মান করেন। এর দীর্ঘ অবয়বটি ছিলো ক্ষীণ ও নমনীয়। মানবদেহের গতিশীল ভঙ্গিমা সুন্দরভাবে প্রকাশ পেয়েছে এতে।

খৃঃ পূঃ ৩৩০ অব্দে “এপোলো” মুর্তিটি আদশমানবদেহের প্রতিরূপ ছিলো। মানবদেহের শারীরিক সুষমা এখানে উপস্থিত।

ভাস্কর লিসিপসের তৈরী সম্রাট আলেকজান্ডারের ভাস্কর্যটি বিখ্যাত। এতে আলেকজান্ডারের বীরত্ব অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

হেলেনিস্টিক যুগে বিখ্যাত ভাস্কর্যের নাম লাওকোন গ্রুপ (লাওকোন এন্ড হিস সন্স, ৭’১০.৫” উচ্চতা)। এখানে পৌরানিক কাহিনী অবলম্বনে দেহগুলোকে তৈরী করা হয়েছে। পশুশক্তির বিরুদ্ধে মানুষের যুদ্ধ আর নিয়তির বিরুদ্ধে মানুষের সংগ্রাম ঠিক কোন্টি শিল্পী তুলে ধরেছেন তা বোঝা যায় না।

শত দ্বীপ আর পাহাড়ে বেষ্টিত গ্রিস আধিপত্য আর সংঘাতের যুদ্ধে বিধ্বস্ত হয়েছিলো অনেক রাজ্য। বিখ্যাত সব ভাস্কর ফিদিয়াস, মাইরন, পলিফ্লাইটিস, প্র্যাক্সিটেলাসের কাজগুলো রোমানদের প্রযতেœ বেচে ছিলো সহস্র বছর। গ্রিক ভাস্কর্যগুলো তাদের সমৃদ্ধশালী শিল্প ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে।

2 comments: