Friday 20 November 2009

কেভ পেইন্টিংস

চিত্রকলার প্রাচীনতম নিদর্শন প্রাগৈতিহাসিক যুগের গুহাচিত্র। পুরাপ্রস্তর যুগের (প্যালিওলিথিক) শিকারী মানুষেরাই এই চিত্রকলার উদ্ভাবক। এসব চিত্রগুলোতে শিকারী শিল্পীরা তাদের ধ্যান ধারনা ও তৎকালীন সমাজ জীবনের অভিজ্ঞতাকে চিত্রকলার মাধ্যমে রূপদানের চেষ্টা করেছে। মানুষ প্রাথমিক অবস্থায় পৃথিবীতে তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে এবং চারপাশের জগৎকে নিজের আয়ত্বে আনার প্রয়াসে এই চিত্রকলার জন্ম দিয়েছে। কিন্তু প্রয়োজন হতে উদ্ভুত হলেও এই চিত্রকলার শিল্প সৌন্দর্য এবং এবং কলাকৌশল আজও মানুষের মনে বিস্ময়ের সৃষ্টি করে।

১৮৭৯ সালে উত্তর স্পেনের সান্টাদের এর নিকটবর্তী স্থানে প্রথম গুহাচিত্র আবিষ্কৃত হয়। আর এসব উল্লেখযোগ্য গুহাগুলো হলো :

আলতামিরা (১৮৭৯, স্পেইন)

লাস্কো (ডর্ডন, ফ্রান্স)

পেয়ার-নন-পেয়ার (১৮৯৬, ফ্রান্স)

ফন্ট-ডি-গুমে (১৯০১, ডর্ডন, ফ্রান্স)

গুহাচিত্রগুলোর মূল বিষয়বস্তু ছিলো শিকার। গুহাবাসী মানুষের প্রধান খাদ্য ছিলো হরিণ ও বাইসনের মাংস। প্রধানত যেসব পশু তারা শিকার করতো তাদের চিত্রই গুহার দেয়ালে আঁকা হতো। এছাড়া ভালুক, ঘোড়া, নেকড়ে ও কিছু কিছু ছবিতে মানুষের ছবিও পাওয়া যায়। ছবিতে এসব জীবজন্তু শিকারের দৃশ্য আহত পশু-পাখী, কিছু অদ্ভুত প্রাণী, জ্যামিতিক চিহ্ন, সাংকেতিক চিহ্ন পাওয়া যায়।

শিকারী শিল্পীর প্রথম প্রযোজন খাদ্য, তা উৎপাদন করতে যখন সে শেখেনি, মস্তিস্ককে সে যখন সুদূরপ্রসারী ভবিষ্যতের কাজে লাগায়নি, সে সময় তার চিত্রে স্বভাবিকভাবেই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার প্রতিফলন ঘটেছিলো। দৃষ্ট বাস্তবের প্রত্যক্ষ ছাপ সে চিত্রে ধরেছিলো। চিত্র তার কাছে ছিলো বাস্তবেরই প্রসারন।প্রাগৈতিহাসিক যুগে গুহাতে ছবি আঁকার পেছনে মানুষের মনে কাজ করেছে এক বিশিষ্ট বিশ্বাস। এ বিশ্বাসকে বলা হয় যাদু বিশ্বাস। গুহার গায়ে ছবি আঁকা হতো তাদের মায়ার ফাঁদে আটকে ফেলার জন্য। অনেক ক্ষেত্রে ছবিতে জন্তুর গায়ে তীর চিহ্ন একে দিয়েছে। তারা বিশ্বাস করতো ছবি নিখুঁতভাবে আঁকতে পারলে ছবির সম্মোহনী শক্তিতে বশীভূত হয়ে পশু ভেতরে প্রবেশ করবে এবং পশু শিকার করা সহজ হবে। লাসকো গুহার দেয়ালে অংকিত একটি ছবিতে দেখানো হয়েছে গন্ডার, একজন আহত মানুষ ও বাইসন। এতে মানুষটির মুখ পাখীর মতো আঁকা হয়েছে। এসব পশুর চিত্রে অস্রাঘাতের দাগ দেখে এটাই বোঝা যায় যে এই আঁকা পশুগুলি তখনকার মানুষের কাছে ছিলো বাস্তব পশুর সত্তা বা দ্বৈত। আঁকা পশুর গায়ে পাথর, তীর প্রভৃতি অস্র ছুড়ে মানুষ প্রকৃতপক্ষে শিকারের প্রাপ্তির কথা ভাবতো। চিত্রগুলো ছিলো একই সঙ্গে ইচ্ছা ও ইচ্ছাপূরণের উপায়। বাস্তব ও অলৌকিকের ভেদ তখনো মানুষের কাছে স্পষ্ট হয়নি,তাই প্রকৃত অবস্থা ও যাদু ক্রিয়ার চরিত্রগত পার্থক্য তার জানা ছিলোনা। ঐ আঁকা পশুগুলি ও তাদের গায়ে অস্রাঘাতের মাধ্যমে ইচ্ছাপূরন তার কাছে ছিলো বাস্তবেরই প্রসারন। এই কারনে সে তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাকেই হুবহু এঁকেছিলো। কোনো কল্পনা বা অলংকরন হতে তাই এই ছবি ছিলো মুক্ত।

পুরানপ্রস্তর যুগের মানুষছিলো সম্পূর্ণ প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল। খাদ্য সংগ্রহের অনিশ্চয়তা তাদের যাযাবর জীবন যাপনে বাধ্য করেছিলো। তাদের আঁকা চিত্র তাদেরই জীবনের উদ্বেগ, উৎকন্ঠা পর্যবেক্ষন প্রক্ষেপিত হয়েছিলো। তাদের আঁকা পশুগুলি এতটাই প্রাণবন্ত ও গতিশীল ছিলো যে চিত্রের গায়ে সত্যিকারের পশুর ত্বক অনুভূত হয়।

গুহাচিত্রগুলোর গুণগত বৈশিষ্ট্য ছিলো অসাধারণ উন্নত পর্যায়ের। প্রসঙ্গত লাসকো গুহার এক্সিয়াল গ্যালারীতে অঙকিত চাইনিস হর্স ছবিটির কথা বলা যায় - এ ছবিতে চীনা পেন্টিঙ্গের শ্রেষ্ঠ সময়ের আঁকা অশ্বের সাথে এদের সাদৃশ্য রয়েছে। চিত্রটিতে চীনা ক্যালিগ্রাফি ও তুলি সঞ্চালনের ক্ষীপ্রতার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।

ছবি আঁকার ক্ষেত্রে শিকারী শিল্পীরা নানা প্রাকৃতিক উপকরন ব্যবহার করেছে। সে সময়ের মানুষ অন্ধকার গুহায় ছবি আঁকতে ব্যবহার করতো পাথরের প্রদ্বীপ যার জ্বালানী ছিলো অস্থির মজ্জা বা চর্বি। রং হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে রঙিন মাটির গুড়া, কয়লা নানা খনিজ দ্রব্য। এসব রঙের সাথে চর্বি মিশিয়ে পশুর লোমের তৈরী তুলির সাহায্যে ছবি এঁকেছে। রঙের প্যালেট হিসেবে ব্যবহার করেছে বৃহৎ সমতল হাড়। এছাড়াও পাথরের টুকরা দিয়ে ঘষে গুহার দেয়ালকে মসৃন করে তার উপর রঙের প্রলেপ দিয়ে ছবি এঁকেছে তারা। রঙের ব্যবহারের পাশাপাশি এসব গুহা চিত্রসমূহে রেখার যথেষ্ট প্রাধান্য ছিলো। বলিষ্ঠ আর প্রাণবন্ত ছিলো এসব রেখা।

সভ্যতার উষালগ্নে মানুষ সম্পূর্ণ বেঁচে থাকার তাগিদে পৃথিবীতে তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে এবং চারপাশের জগৎকে নিজের আয়ত্বে আনার প্রয়াসে স্বতঃস্ফূর্তভাবে গুহাচিত্রগুলো সৃষ্টি করেছে। প্রাগৈতিহাসিক যুগের শিকারী শিল্পীর অনন্য অবদান এই গুহাচিত্রগুলো। বস্তুতঃ চিত্রগুলো সৌন্দর্যবোধ হতে সৃষ্টি হয়নি। কিন্তু প্রয়োজন হতে সৃষ্টি হলেও আমাদের চিত্রশিল্পের ইতিহাসে এর গুরুত্ব অনস্বীকার্য।

1 comment: